Kanchkura Darbar Sharif Khalifa-E- Gawsulazam Maizvandari Hazrat Mawlana Shah Sufi Abdul Motalib (M.J.A)
search
APR
25
মসনবী শরীফ
মূল: মাওলানা রুমী (রহ:)
অনুবাদক: এ, বি, এম, আবদুল মান্নান
মুমতাজুল মোহদ্দেসীন, কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা।
[বাংলা এই ভাবানুবাদ বরিশাল থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে প্রকাশিত। এই দুর্লভ সংস্করণটি সরবরাহ করছেন সুহৃদ (ব্যাংকার) নাঈমুল আহসান সাহেব। লেখা প্রাপ্তি সাপেক্ষে প্রকাশ হতে থাকবে, ইনশা’আল্লাহ। সম্পাদক - কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন]
বিশনু আজ না এচুঁ হেকাইযে মিকুনাদ,
ওয়াজ জুদাই হা শিকাইয়েত মীকুনাদ।
অর্থ: মাওলানা রুমী (রহ:) বলেন, বাঁশের বাঁশি যখন বাজে, তখন তোমরা মন দিয়া শোন, সে কী বলে। সে তাহার বিরহ বেদনায় অনুতপ্ত হইয়া ক্রন্দন করিতেছে।
ভাব: এখানে বাঁশের বাঁশি মানব-রূহের সাথে তুলনা করা হইয়াছে।মানব রূহ আলমে আরওয়াহের মধ্যে আল্লাহর পবিত্র স্থায়ী ভালোবাসায় নিমগ্ন ছিল। ইহ-জগতে আগমন করিয়া পার্থিব বস্তুর ভালোবাসার প্রভাবে আল্লাহর ভালোবাসা ভুলিয়া গিয়াছে। এখন যদি ঐশী ইচ্ছার আকর্ষণে বা কোনো কামেল লোকের সাহচর্যে অথবা কোনো প্রেমের কাহিনী পাঠে নিজের প্রকৃত গুণাবলী ও অবস্থার প্রতি সজাগ হয়, তখন খোদার প্রেমও চিরশান্তির জন্য অনুতপ্ত ও দুঃখিত হইয়া নিজের ভাষায় যে রূপ অনুশোচনা প্রকাশ করে, উহাকেই বাঁশি সুরের সাথে তুলনা করিয়া প্রকাশ করা হইয়াছে।মানব-রূহের বিভিন্ন গুণ আছে। যেমন-মহব্বতে রব্বানী, মারেফাতে ইলাহী ও জেকরে দায়েমী। ইহ-জগতে ইহার প্রত্যেকটিতেই কিছু না কিছু ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলিয়া এক একটি স্মরণ করিয়া অনুতপ্ত হইয়া দুঃখ প্রকাশ করিতে থাকে। এইজন্য মাওলানা বলেন, বাঁশি কয়েক প্রকার বিরহের ব্যথা প্রকাশ করিতেছে।
কাজ নাইয়াছতান তা মরা ব বুরিদাহআন্দ,
আজ নফিরাম মরদো জন নালিদাহআন্দ।
অর্থ: বাঁশি বলে আমি বাঁশের ঝাড়ের মধ্যে আপন জনের সাথে সুখে শান্তিতে বসবাস করিতেছিলাম। সেখান থেকে আমাকে কাটিয়া পৃথক করিয়া আনা হইয়াছে। সেই জুদাইর কারণে আমি ব্যথিত হইয়া বিরহ যন্ত্রণায় ক্রন্দন করিতেছি। আমার বিরহ ব্যথায় মানবজাতি সহানুভূতির ক্রন্দন করিতেছে।
ছিনাহ খাহাম শরাহ শরাহ আজ ফেরাক,
তা বগুইয়াম শরেহ দরদে ইশতিয়াক।
অর্থ: বাঁশি বলিতেছে – আমার বিচ্ছেদের ব্যথা অনুভব করার জন্য ভুক্তভোগী অন্তরের আবশ্যক। পাষাণ অন্তঃকরণ আমার যাতনা অনুভব করিতে পারিবে না। তাই, যে অন্তঃকরণ বিচ্ছেদের ব্যথায় টুকরা টুকরা হইয়া গিয়াছে, সেই অন্তঃকরণ পাইলেই আমার ব্যথা ব্যক্ত করিবো। অন্যথায় আমার রোদন বৃথা যাইবে।
ভাব: যে ব্যক্তির রূহ আলমে আরওয়াহের ভালোবাসার কথা স্মরণ করিয়া কাঁদিতেছে, সেই ব্যক্তি-ই বাঁশির সুরের মর্ম অনুধাবন করিয়া মর্মাহত হইবে। অন্য কেহ সুরের মর্ম বুঝিতে পারিবে না।
হরকাছে কো দূরে মানাদ আজ আছলে খেশ,
বাজে জুইয়াদ রোজে গারে ওয়াছলে খেশ।
অর্থ: যে ব্যক্তি নিজের আপনজন হইতে দূরে সরিয়া পড়ে, নিশ্চয়ই সে আপন জনের সাথে মিলিত হইবার জন্য আকাঙ্ক্ষা রাখে। সেই রকম মানব রূহ ও আলমে আরওয়াহের স্থায়ী শান্তি হইতে বহু দূরে সরিয়া পড়িয়াছে, পুনঃ সেই স্থান পাইবার জন্য ব্যাকুল রহিয়াছে।
মান বাহর জামিয়াতে নাঁলানে শোদাম,
জুফতে খোশ হালানো বদ হালানে শোদাম।
অর্থ: বাঁশি বলিতেছে যে আমার দুঃখ ও ক্রন্দনের অবস্থা কাহারও নিকট অপ্রকাশ্য নাই। ভাল-মন্দ প্রত্যেকের নিকট-ই আমার অবস্থা প্রকাশ হইয়া রহিয়াছে।
হরকাছে আজ জন্নে খোদ শোদ ইয়ারে মান
ওয়াজ দরুনে মান না জুস্ত আছরারে মান।
অর্থ: প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবস্থা অনুসারে আমার প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করিয়াছে।আমার জন্য দুঃখ প্রকাশ করিয়াছে।কিন্তু আমার অভ্যন্তরীণ প্রকৃত ব্যথা কেহ-ই বুঝিতে পারে নাই। আর কেহ ব্যথার কারণও অন্বেষণ করে নাই।
ছিররে মান আজ নালায়ে মা দূরে নিস্ত,
লেকে চশমো গোশেরা আঁনূরে নিস্ত।
অর্থ: বাঁশি বলিতেছে, আমার ক্রন্দন হইতে ক্রন্দনের রহস্য পৃথক নয়। কিন্তু প্রকাশ্য চক্ষু ও কর্ণে উহা দেখিবার সেই আলো ও শুনিবার সেই শক্তি নাই। অর্থাৎ, শুধু ইন্দ্রিয়ের দ্বারা উহা অনুভব করা যায় না। ইন্দ্রিয়ের সাথে অনুভূতি শক্তির দরকার। যাহার অনুভূতি শক্তি অতি প্রখর, সে-ই আমার ব্যথা অনুভব করিতে পারিবে। যেমন, ক্ষুধার্তের ক্ষুধার জ্বালা ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করা যায় না। ভুক্তভোগী ছাড়া অন্যে অনুভব করিতে পারে না। সেই রকম বাঁশির বিরহ ব্যথা ভুক্তভোগী ছাড়া অন্য কেহ বুঝিতে পারে না।
তন জে জান ও জান জেতন মস্তুরে নিস্ত,
লেকে কাছরা দিদে জান দস্তুরে নিস্ত।
অর্থ: উপরোক্ত ভাবকে আরো সম্প্রসারণ করিয়া বলিতেছে যে, যেমন দেহ হইতে আত্মা এবং আত্মা হইতে দেহ দূরে নয়, বরং একত্রিত; কিন্তু কাহকেও কেহ দেখিবার বিধান নাই; সেই রকম আমার কান্না হইতে কান্নার ভেদ ভিন্ন নয়। কান্নার অন্তর্নিহিত কান্নার ভেদ প্রকাশ পাইতেছে। কিন্তু শুধু চক্ষু ও কর্ণ দ্বারা বুঝিবার শক্তি নাই।
আতেশাস্ত ইঁ বাংগে সায়ে ও নিস্তে বাদ,
হরফে ইঁ আতেশে নাদারাদ নিস্তে বাদ।
অর্থ: বাঁশির সুর আগুনের ন্যায় অন্যের অন্তর প্রজ্জ্বলিত করিয়া চলিতেছে। বাঁশির সুরে যাহার অন্তঃকরণ জ্বলিয়া না উঠে, তাহার অন্তঃকরণ না থাকা-ই ভাল। এমন অন্তঃকরণ ধ্বংস হওয়া-ই উত্তম।
ভাব: প্রকৃত খোদা-প্রেমিকের সাহচর্যে থাকিলে, তাহার অন্তরেও খোদার প্রেম জাগরিত হইয়া উঠে।
আতেশে ইশ্ কাস্ত কান্দর নায়ে ফাতাদ
জোশশে ইশ্ কাস্ত কান্দর মায়েফাতাদ।
অর্থ: প্রেমের অগ্নি বাঁশির সুরে নিহিত আছে এবং প্রেমের উত্তেজনা শরাবের মধ্যে বিরাজ করিতেছে।
ভাব: আল্লাহর মহব্বত পবিত্র শরাব-স্বরূপ। যে ব্যক্তির মধ্যে আল্লাহর মহব্বত জ্বলিয়া উঠে, আল্লাহর জন্য পাগল হইয়া যায়, তাহাকেই আশেকে হাকিকী বলে।
নায়ে হারিফে হরকে আজ ইয়ারে যুরিদ,
পরদাহায়েশ পরদাহায়ে মা দরিদ।
অর্থ: যে ব্যক্তি প্রিয়জনের বিরহ যাতনায় জ্বলিতেছে, সেই ব্যক্তি-ই বাঁশির বন্ধুরূপে পরিগণিত হইয়াছে।
মাওলানা রুমী বলিতেছেন, বাঁশির সুরের অন্তর্নিহিত মর্মে আমার অন্তর্নিহিত বেদনা জ্বলিয়া উঠিয়াছে।
ভাব: প্রত্যেক মানব-রূহ আলমে আরওয়াহ্ হইতে ইহ-জগতে আসিয়া আল্লাহর মহব্বত হইতে দূরে নিপতিত হইয়া মানব দেহের মধ্যে থাকিয়া সে সর্বদা আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য বাঁশির ন্যায় ক্রন্দন করিতেছে। কিন্তু, মানবজাতি দুনিয়ার মহব্বতে পড়িয়া উক্ত রূহের অবস্থা অনুভব করিতে পারে না। যদি কোনো কামেল লোকের সাহায্য অবলম্বন করিয়া দুনিয়ার মহব্বত অন্তর হইতে বিদূরিত করিতে পারে, তখন সে রূহের অবস্থা অনুভব করিতে পারিবে।
হামচু নায়ে জহরে ও তরইয়াকে কেদীদ,
হামচু নায়ে ও মছাজে ও মুশ্ তাকে কেদীদ।
অর্থ: বাঁশির সুরের ক্রিয়ার কথা যখন উপরে উল্লেখ করা হইয়াছে, তাই মাওলানা এখন বলিতেছেন, বাঁশির সুরের ন্যায় মৃত অন্তরকে জীবিত করিতে অন্য কোনো তরিয়াক বা অমোঘ ঔষধ নাই। বাঁশির সুরের ন্যায় উপযুক্ত উত্তেজনাকারী আর কিছু দেখা যায় না।
নায়ে হাদীসে রাহে পোর খুন মী কুনাদ,
কেচ্ছাহায়ে ইশকে মজনুন মী কুনাদ।
অর্থ: বাঁশির সুরে প্রেমের রাস্তা রক্তাক্ত করিয়া তুলে। সে প্রকৃত আশেকের অবস্থা বর্ণনা করিতে থাকে।
মোহররমে ইঁ হুশে জুযবে হুশে নিস্ত।
মর জবান রা মুশতারি চুঁ গোশে নিস্ত।
অর্থ: বাঁশির কেচ্ছা দ্বারা ইহা পরিষ্কার বুঝা যায় যে, প্রকৃত আশেকের নিকট মাশুক ব্যতীত অন্য কাহারও খেয়াল না থাকা-ই ইশকের সুস্থ জ্ঞানের লক্ষণ।
ভাব: প্রকৃত খোদা-প্রেমিক খোদা ব্যতীত অন্য কাহারও খেয়াল না করা-ই খাঁটি বান্দার পরিচয়।
যেমন – মুখে কথা বলিলে কর্ণেই শুনে, অন্য কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের শুনার অধিকার নাই; সেইরূপ খাটি আশেকের মাশুক ব্যতীত অন্য কাহাকেও তলব করার অধিকার থাকে না।
গার না বুদে নালায়ে নায়ে রা সামার,
নায়ে জাহান রা পুর না করদে আজ শাক্কর।
অর্থ: যদি বাঁশির ক্রন্দনে কোন ফল লাভ না হইত, তবে ইহ-জগতে বাঁশির সুর মধুরতায় পূর্ণ হইত না।
ভাব: আশেকের ইশকের দরুন যাহা লাভ করা যায়, বাঁশির সুরের দরুন উহাই হাসিল করা যায়।
দরগমে মা রোজেহা বেনাহ-শোদ,
রোজেহা বা ছুজেহা হামরাহ শোদ।
অর্থ: বাঁশি বলে, আমার বন্ধুর বিরহ-যাতনার দুঃখে আমার জীবনকাল অনর্থক কাটিতেছে। জীবনকাল দুঃখময় হইয়া অতিবাহিত হইতেছে।
ভাব: প্রকৃত বন্ধু অন্বেষণকারী বন্ধুর মিলনেও শান্তি পায় না। কেননা, মিলনের অনেকগুলি স্তর আছে। ঐগুলি অতিক্রম করার জন্য সর্বদা ব্যস্ত থাকে। অতএব, প্রকৃত আশেকের জন্য কোনো অবস্থা-ই শান্তি বা তৃপ্তির নয়। সদা-সর্বদা পরিপূর্ণতা লাভের জন্য ব্যাকুল থাকে।
রোজেহা গার রফত গো রাওবাকে নিস্ত
তু বেমাঁ আযে আঁকে চুঁতু পাকে নিস্ত।
অর্থ: যদিও আমার অতীত জীবন বেহুদা কাটিয়া গিয়াছে, তথাপি আফসোসের কোনো কারণ নাই। কেননা, যাহা বেহুদা ছিল বা বিপদ-আপদ ছিল, তাহা চলিয়া গিয়াছে; এখন খাঁটি ও পবিত্র প্রেম বাকি রহিয়াছে।
ভাব: বহুদিন বিরহ, যাতনা ও বেদনার পর যদি বন্ধুর মিলন হয়, তবে পিছনের দুঃখ-কষ্টের জন্য আফসোস করিতে হয় না। কেননা, যাহা কিছু অনর্থক দুঃখকষ্ট ভোগ করার ছিল তাহা অতিক্রান্ত হইয়া গিয়াছে। এখন শুধু ভালোবাসা বা প্রেম স্থায়ী রহিয়াছে।
হরকে জুজ মাহী জে আবশ ছায়েরে শোদ,
হরকে বেরোজী ইস্ত রোজশ দের শোদ।
অর্থ: এখানে আশেকের প্রকার বর্ণনা করিতে যাইয়া মওলানা বলিতেছেন, এক প্রকার আশেক আছে, যাহারা মাশুকের কিছু প্রাপ্ত হইলেই তৃপ্তি লাভ করে। আরেক প্রকার আছে, যাহারা মাশুককে লাভ করিতে পারে নাই, তাহাদিগকে বে-রুজি বলা হইয়াছে। তাহাদের চেষ্টা বিফল হইয়াছে। তাহাদের জীবন বৃথা অতিবাহিত হইয়া গিয়াছে। উদ্দেশ্য পণ্ড হইয়া গিয়াছে।
ভাব: প্রেমিকের জন্য প্রেমের পথে চলিতে কখনও থামিতে হয় না, সর্বদা চলিতে থাকিলেই উদ্দেশ্য সফল হয়। নিরাশ হবার কোনো কারণ নাই।
ওয়ার নাইয়াবদ হালে পোখতাহ হিচে খাম,
পাছ ছুখান কোতাহ বাইয়াদ ওয়াচ্ছালাম।
অর্থ: বিফল ব্যক্তি কখনও সফল ব্যক্তির অবস্থা অনুভব করিতে পারে না। কামেল ব্যক্তির অবস্থা বিনা কামেল-ব্যক্তি কখনও বুঝিতে পারে না। এই জন্য উপরোল্লিখিত পূর্ণ প্রেমের উত্তেজনার ফলাফল বর্ণনা করা এখন সংক্ষেপ করিয়া শেষ করা হইল। শেষ করা-ই উত্তম।
বন্দে বগছাল বাশ আজাদ আয়ে পেছার,
চান্দে বাঁশি বন্দে ছীমো বন্দে জর।
অর্থ: মাওলানা বলেন, ওহে যুবক! তুমি যদি খোদার প্রেমে পরিপূর্ণতা লাভ করিতে চাও, তবে তুমি দুনিয়ার ধন-দৌলত ও স্বর্ণ-রৌপ্যের মহব্বত ত্যাগ কর; তবে খোদার ভালোবাসা লাভ করিতে পারিবে। কেননা, দুনিয়ার ধন-দৌলতের মহব্বত রাখিলে আল্লাহর মহব্বত হাসিল করা যায় না। দুনিয়ার ভালোবাসা আল্লাহর মহব্বত হইতে ফিরাইয়া রাখে।পার্থিব বস্তুর মহব্বত যত কম হইবে, ততই আল্লাহর মহব্বত বেশি হইবে। আস্তে আস্তে, ক্রমান্বয়ে কামেল হইতে থাকিবে।
গার বা রিজি বহরেরা দর কুজায়ে,
চান্দে গুনজাদ কিসমতে এক রোজায়ে।
অর্থ: মাওলানা দুনিয়ার লোভীর পরিণতি সম্বন্ধে বলিতে যাইয়া বলিতেছেন যে, অধিক লালসা করায় কোনো ফলোদয় হয় না। যেমন, সমস্ত সমুদ্রের পানি যদি একটি সামান্য পেয়ালার মধ্যে ঢালা হয়, তবে উহার মধ্যে পেয়ালা আন্দাজ পানি থাকিবে, অতিরিক্ত পানি উহাতে কিছুতেই থাকিবে না; শুধু একদিনের পরিমাণ পানি থাকিতে পারে।
ভাব: এখানে পিয়ালাকে মানুষের অদৃষ্টের সাথে তুলনা করা হইয়াছে। যাহার অদৃষ্টে যে পরিমাণ নির্দিষ্ট করা আছে, উহার চাইতে কিছুতেই সে বেশি পাইবে না। অতএব, অধিক লোভ-লালসায় মত্ত হওয়া কোনো উপকারে আসে না, বরং খোদার মহব্বত হইতে বঞ্চিত হইতে হয়।
কুজায়ে চশমে হারিছান পুর না শোদ,
তা ছাদাপে কানে না শোদ পুর দুর না শোদ।
অর্থ: লোভী ব্যক্তির চক্ষু কোনো সময়েই পরিপূর্ণ হয় না। অর্থাৎ, লালসার আশা মিটে না, কখনও তৃপ্তি লাভ করিতে পারে না। যদি ইহ-জগতে যাহা পায় তাহাতে তৃপ্তি লাভ না করে, তবে ঝিনুকের ন্যায় যদি এক ফোঁটা বৃষ্টি পাইয়া তৃপ্তি লাভ করিয়া মুখ বন্ধ না করে, তাহা হইলে সে কী-রূপে পূর্ণ এক খণ্ড মূল্যবান মুক্তায় পরিণত হইতে পারিবে? অতএব, আল্লাহর তরফ হইতে বান্দার কিসমতে যাহা কিছু মাপা হয়, তাহাতেই সন্তুষ্টি লাভ করিয়া ধৈর্য্ ধারণ করিয়া থাকিলে খোদার প্রিয় বান্দা বলিয়া পরিগণিত হইতে পারে।
হরকেরা জামা জে ইশকে চাকে শোদ,
উ জে হেরচো আয়েবে কুল্লি পাকে শোদ।
অর্থ: যে ব্যক্তির জামা ইশকের কারণে ফাঁড়িয়া গিয়াছে, সে ব্যক্তির অন্তর লোভ-লালসা ও অন্যান্য কু-ধারণা হইতে পবিত্র হইয়া গিয়াছে।
ভাব: যে ব্যক্তির অন্তর খোদার মহব্বতে পরিপূর্ণ হইয়া গিয়াছে, তাহার অন্তঃকরণ হইতে পার্থিব বস্তুর ভালোবাসা দূর হইয়া গিয়াছে। তিনি প্রকৃত কামেল হইতে পারিয়াছেন।
শাদে বশ্ ইশকে খোশ্ ছুদায়ে মা
আয়ে তবিবে জুমলায়ে ইল্লাত হায়ে মা।
অর্থ: এখানে মাওলানা ইশকের প্রশংসা করিতে যাইয়া বলিতেছেন, হে ইশক! তোমাকে ধন্যবাদ দিতেছি। কারণ, তোমার অসিলায় অভ্যন্তরীণ কু-ধারণাসমূহ বিদূরিত হয়। তোমার-ই কারণে অন্তঃকরণ পবিত্র হয়। অতএব, হে চিকিৎসক! তোমাকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপণ করিতেছি।
আয়ে দাওয়ায়ে নাখুত ও নামুছে মা,
আয়ে তু আফলাতুনো জালিয়ে নুছেমা।
অর্থ: হে ইশক, তুমি আমার কু-ধারণা ও কু-প্রবৃত্তির ঔষধস্বরূপ। তুমি আমার পক্ষে জালিয়ানুসের ন্যায় একজন বিজ্ঞ ডাক্তার। অর্থাৎ, প্রকৃত প্রেমিক ব্যক্তি কোনো সময়ে অ-সুন্দর বা না-পছন্দ কাজ করিতে পারেন না। খাঁটি প্রেমের কারণে না-পছন্দ গুণসমূহ তাহার অন্তর হইতে বিদূরিত হইয়া যায়।
জেছমে খাক আজ ইশকে বর আফলাকে শোদ,
কুহে দর রকছে আমদ ও চালাক শোদ।
অর্থ: মাটির শরীর খোদার ইশকের দরুন আকাশ ভ্রমণ করিয়াছে। মুছা (আঃ)-এর ইশকের দৃষ্টিতে তূর পর্বতের প্রাণ সঞ্চার হইয়াছিল এবং ইশকের জোশে ফাটিয়া চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া গিয়াছিল ও হজরত মূছা (আ:) বে-হুশ হইয়া রহিলেন।
ইশকে জানে তুরে আমদ আশেকা,
তুরে মস্তো খাররা মুছা ছায়েকা।
অর্থ: পরবর্তী লাইন-দ্বয়ে মাওলানা পরিষ্কার করিয়া বর্ণনা করিয়া দিয়াছেন, যেমন হজরত মূসা (আ:)-এর খোদার প্রেমপূর্ণ দৃষ্টি যখন তূর পর্বতের উপর পতিত হইল, তখন-ই তূর পর্বত ইশকের ক্রিয়ায় নড়া-চড়ার শক্তি পাইল এবং নাচিতে আরম্ভ করিল। অবশেষে সে চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া পড়িল এবং মূসা (আঃ) খোদার জ্যোতির প্রভাবে বে-হুশ হইয়া রহিলেন।
বা লবে ও মছাজে খোদ গার জোফতামে,
হামচু নায়ে মান গোফতানিহা গোফতামে।
অর্থ: উপরোক্ত লাইন-দ্বয়ে মাওলানা ইশকের ফজিলত ও শওকাত বর্ণনা করিতেছিলেন এবং খুব ভালভাবে ইশকের মরতবা বর্ণনা করার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু, তিনি যখন ভাবিলেন যে ইশকের রহস্য ও শওকাত বাহ্যিক ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করা সম্ভব নয়, প্রকৃত আশেক না হইলে ইশকের স্বাদ গ্রহণ করিতে পারে না; ইশকের মধ্যে এমন গুরুত্বপূণ রহস্য আছে, যাহা বয়ান করিলে কোনো কোনো লোক বেঈমান হইয়া যাইবার আশষ্কা আছে, তখন তিনি নিজের কৈফিয়ৎ হিসাবে ওজর বর্ণনা করিতেছেন যে যদি আমার সম্মুখে আমার বর্ণনা শুনার জন্য কোনো খাঁটি আশেক থাকিত, তবে আমি বাঁশির ন্যায় ইশকের কেচ্ছা বর্ণনা করিতাম।
হরফে উ আজ হামজবানে শোদ জুদা,
বে নাওয়া শোদ গারচে দারাদ ছদ নাওয়া।
অর্থ: যে ব্যক্তি নিজের ভাষা-ভাষী হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়ে, তখন সে সম্বলহীন অবস্থায় অসহায় হইয়া পড়ে। যদিও তাহার নিকট শত ধন-দৌলত থাকে, তথাপিও সে নিজেকে অসহায় মনে করে। কেননা, সে নিজের মনোবাসনা প্রকাশ করিতে পারে না।
চুঁকে গোল রফতো গুলিস্তান দর গুজাস্ত,
নাশ নুবি জীঁ পাছ জে বুলবুল ছার গুজাস্ত।
অর্থ: মাওলানা উপরোক্ত ভাবের বর্ণনায় দৃষ্টান্ত দিয়া বলিতেছেন, দেখ, যখন ফুল ফোটার মৌসুম চলিয়া যায়, তখন ফুলের বাগিচা ফুলশূন্য হইয়া পড়ে এবং দেখিতে অসুন্দর দেখায়। বুলবুল পাখি আর গান করিতে আসে না। কারণ ফুলের সুঘ্রাণের আকর্ষণে সে গান করিতে আসিত। এখন ফুল ফোটে না আর সে-ও গান গাহিতে আসে না। এইরূপভাবে যদি শ্রোতা আকর্ষণকারী প্রেমিক না হয়, তবে বর্ণনাকারীও বর্ণনা করিতে স্বাদ পায় না। অতএব, বর্ণনা হইতে বিরত থাকে।
ছেররে পেনহা নাস্ত আন্দর জীরো বাম,
ফাশ আগার গুইয়াম জাহাঁ বরহাম জানাম।
অর্থ: মাওলানা বলিতেছেন, আমি যে কাহিনী চুপে চুপে নিম্নস্বরে বা উচ্চস্বরে বর্ণনা করিতেছি, ইহার ভেদ ও রহস্য আওয়াজের ভিতরে নিহিত আছে। যদি প্রকাশ্যে বর্ণনা করি, তবে সমস্ত জাহান ধ্বংস হইয়া যাইবে।
আঁচে নায়ে মী গুইয়াদ আন্দরইঁ দো বাব,
গার বগুইয়াম মান জাহাঁ গরদাদ খারাব।
অর্থ: যাহা কিছু বাঁশি উচ্চস্বরে ও নিম্নস্বরে ব্যক্ত করিতেছে, আমি যদি উহা ব্যক্ত করি, তবে ইহ-জগৎ ধ্বংস হইয়া যাইবে।
ভাব: বাঁশির সুরে নিহিত রহস্য ইহাই প্রকাশ করিতেছে যে, এই বিশ্বে এক আল্লাহতায়ালা ব্যতীত অন্য কিছুরই অস্তিত্ব দেখা যায় না। যাহা কিছু বিরাজ করিতেছে, সবই আল্লাহর অস্তিত্ব মা ছেওয়ায়ে আল্লাহর কিছুই দেখা যায় না। বিশ্বে যাহা কিছু সৃষ্টি করা হইয়াছে সবই মানুষের জন্য। যদি মানুষ না থাকে, তবে কিছুই থাকিবে না। যেমন আল্লাহতায়ালা বলিয়াছেন, যদি আমি মানুষের কর্মফলের দরুন সবাইকে উঠাইয়া নেই, তবে পৃথিবীর বুকে অন্য কোন প্রাণী দেখিতে পাইবে না।
জুমলা মা শু কাস্ত ও আশেক পরদাহই,
জেন্দাহ মা শু কাস্ত ও আশেক মোরদাহই।
অর্থ: মাওলানা বলিতেছেন, এই পৃথিবীতে যাহা কিছু দেখিতেছ, সবই আল্লাহর অস্তিত্বের নমুনা, সবই আল্লাহর। খাঁটি আল্লাহর আশেক যাহারা, তাহাদের পক্ষে যাহা কিছু দেখা যায়, সবই আল্লাহর নমুনা। সেইজন্য মাওলানা এখানে সকলকেই মাশুক বলিয়াছেন। অর্থাৎ, প্রেমিকের পক্ষে ইহ-জগতের সবই মাশুক। সকলকেই ভালবাসিবে। কিন্তু মানুষ আশেক; আশেকের মন পার্থিব বস্তুর আকর্ষণে নিহিত, আল্লাহর মহব্বতকে অনুভব করিতে পারে না। এইজন্য আশেককে পর্দার আড়ালে বলিয়াছেন। অর্থাৎ পৃথিবীর সকল বস্তুই মাশুক, কিন্তু আশেক পর্দার আড়ালে রহিয়াছে। মাশুককে চক্ষে দেখে না। এইজন্য দ্বিতীয় লাইনে বলা হইয়াছে যে, মাশুক জীবিত বিদ্যমান। কিন্তু আশেকরা মৃত অবস্থায় আছে। জীবিত থাকিয়াও মৃত্যের ন্যায় কোন কাজ করিতেছে না।
ভাব: ইহ-জগতে যাহা কিছু খোদার সৃষ্টি দেখা যায়, সবই খোদার কীর্তিকলাপ। ইহা দেখিয়া খোদাকে পাইবার জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠিতে হয়। কিন্তু মানুষ ইহ-জগতের লোভ লালসায় মত্ত হইয়া খোদাকে ভুলিয়া রহিয়াছে। তাই মানুষকে মৃত বলিয়া আখ্যা দেওয়া হইয়াছে।
চুঁ নাবাশদ ইশকেরা পরওয়ায়ে উ,
উঁচু মোরগে মানাদ বে পরওয়ায়ে উ।
অর্থ: যদি ইশক বা মহব্বতের কোনো ক্রিয়া না থাকিত, তবে বান্দাগণ পাখাবিহীন পাখির ন্যায় অসহায় অবস্থায় পড়িত।
ভাব: ইশকের দরুন বান্দাহ্ আল্লাহর নৈকট্য লাভ করিতে পারে। যদি ইশকের কোনো তাসির না হইত, তবে মানুষ খোদার নৈকট্য লাভ করিতে পারিত না। পাখাশূন্য পাখির ন্যায় দুর্দশায় পতিত হইত। কখনও আল্লাহর প্রিয় বান্দাহ হইতে পারিত না।
মানচে গুনা হুশে দারাম পেশ ও পাছ,
চুঁ নাবাশদ নূরে ইয়ারাম হাম নফছ।
অর্থ: মাওলানা বলিতেছেন, যদি আল্লাহর তরফ হইতে আমার প্রতি ইশকের নূরের সাহায্য বর্ষিত না হয়, তবে আমার ভূত ও ভবিষ্যৎকাল কেমন করিয়া শান্তিতে কাটিবে? পদে পদে আমার শত্রুরা সজাগ আছে, যদি মেহেরবান খোদা আমাকে রক্ষা না করেন, তবে আমার ধ্বংস অনিবার্য।
নূরে উদর ইয়ামন ওইয়াছার ও তাহাতো ফাউক,
বর ছারো বর গেরদানাম মানান্দ তাউক।
অর্থ: মাওলানা আল্লাহর নূরের সাহায্যের কথা বর্ণনা করিতে যাইয়া বলিতেছেন, আল্লাহর নূরের দান ও রহমত আমাকে বেষ্টন করিয়া রাখিয়াছে। আমার ডাইন-বাম ও উপর-নিচ চতুর্দিক দিয়াই আল্লাহর নূরে ঘিরিয়া আছে। কোনো অবস্থায়েই আমি আল্লাহর দানের বাহিরে নহি।
ইশক খাহাদ কেইঁ চুখান বিরুঁ রওয়াদ,
আয়নায়ে গাম্মাজ নাবুদ চুঁ বওযাদ।
অর্থ: মাওলানা বলেন, ইশকের কাহিনী বহু লম্বা-চওড়া, উহার কোনো সীমা নাই। কারণ, আল্লাহতায়ালা অসীম। তাঁহার কাহিনীও সীমাহীন। ইহা অনুভব করার জন্য পুতঃপবিত্র অন্তর চাই। সাধারণের ইহা বুঝিবার শক্তি নাই। তাই সংক্ষেপ করিলাম। পরিষ্কার আয়না না হইলে যেভাবে প্রতিচ্ছবি সঠিক পতিত হয় না, সেইরূপ পবিত্র অন্তর না হইলে খোদার প্রেমের কাহিনীর রহস্য সঠিক অনুধাবন করিতে পারে না।
আয়ে নাত দানি চেরা গাম্মাজ নিস্ত,
জাঁকে জংগার আজ রোখশে মোমতাজ নিস্ত।
অর্থ: শ্রোতাগণ ইশকের কাহিনী পরিপূর্ণভাবে অনুধাবন করিতেছে না কেন? মওলানা উহার কারণ ব্যাখ্যা করিতেছেন যে, শ্রোতাদের অন্তঃকরণ পবিত্র নাই। দুনিয়ার মহব্বতের কারণে অন্তরে মরিচা পড়িয়া গিয়াছে। অন্তর হইতে আল্লাহর মহব্বতের আলো বাহির হয় না। তাই, আল্লাহর মহব্বতের আকর্ষণ পাইতেছে না, অন্ধকারে রহিয়াছে।
আয়নায়ে কাজ জংগো আলায়েশ জুদাস্ত,
পুর শোয়ায়ে নূরে খুরশীদে খোদাস্ত।
অর্থ: মাওলানা পবিত্র অন্তঃকরণের বর্ণনা করিতে যাইয়া বলিতেছেন, যে সকল অন্তঃকরণ ময়লা ও আবর্জনা হইতে পবিত্র ও পরিষ্কার, ঐসব অন্তঃকরণ আল্লাহর নূরে আলোকিত থাকে। এবং তাহাদের উপর আল্লাহর অনুগ্রহ বর্ষণ হইতে থাকে।
রাও তু জংগার আজ রুখে উ পাকে কুন,
বাদে আজাঁ আ নূরে রা ইদরাকে কুন।
অর্থ: মাওলানা বলিতেছেন, তোমাদের অন্তরকে ময়লা ও মরিচা হইতে পরিষ্কার করা উচিত। অন্তঃকরণ পবিত্র কর, তবে দেখিতে পাইবে যে, তোমার অন্তর আল্লাহর নূরে আলোকিত হইয়া গিয়াছে। আল্লাহর মহব্বতে দেল পরিপূর্ণ হইয়া গিয়াছে।
নকল: কোনো এক বাদশাহ এক লাস্যময়ী দাসীর প্রতি আশেক হওয়া এবং ঐ দাসীকে খরিদ করা ও দাসী রোগাক্রান্ত হওয়ার পর তাহার সুচিকিৎসার বন্দোবস্ত করার ঘটনা।
বিশ্ নুইয়েদ আয়ে দোছেতাঁ ইঁ দাছেতাঁ,
খোদ হাকিকাতে নকদে হালে মাস্ত আঁ।
অর্থ: মাওলানা বলেন, হে বন্ধুগণ, তোমরা মনোযোগ সহকারে এই ঘটনা শুনো। এই ঘটনা প্রকৃতপক্ষে আমার অবস্থার ন্যায়।
ভাব: মাওলানার অবস্থার ন্যায় হওয়ার কারণ এই যে, এই ঘটনায় বাদশাহ্ যেভাবে দাসীর প্রতি আশেক হইয়াছে, ঐরূপভাবে মানব-রূহ বাদশাহ-স্বরূপ, আর ‘নফছে আম্মারা’ দাসী-রূপ। রূহ্ নফছের বাধ্যগত হইয়া আশেক হইয়া পড়িয়াছে। যেরূপভাবে বাদশাহর দাসী স্বর্ণকারের প্রতি আশেক হইয়া পড়িয়াছে। সেইভাবে নফছ দুনিয়ার প্রতি আশেক হইয়া পড়িয়াছে। অর্থাৎ, বাদশাহ চায় দাসীকে। দাসী চায় স্বর্ণকারকে। ঐরূপভাবে রূহ নফছের প্রতি আশেক হইয়া পড়িয়াছে। সেইভাবে নফছ দুনিয়ার প্রতি মোহাচ্ছন্ন হইয়াছে। নফছ দুনিয়ার মালমাত্তা ও ভালবাসার প্রতি আশেক হইয়া পড়িয়াছে। ইশকে হাকিকীর দিকে কাহারও লক্ষ্য নাই। আল্লাহর মহব্বতের প্রতি কাহারও লক্ষ্য নাই। এমতাবস্থায় এই রোগের দাওয়া যেমন-বাদশাহ্ আল্লাহর তরফ হইতে চিকিৎসক পাইয়া তাহার দ্বারা চিকিৎসা করাইয়া স্বর্ণকারকে বদ-সুরত করিয়া দিয়াছিল এবং দাসী তাহাকে খারাপ চক্ষে দেখিয়া না-পছন্দ করিল; অবশেষে স্বর্ণকারকে ধ্বংস করিয়া ফেলিল। এইরূপ তদবীর করায় দাসী সুস্থ হইয়া উঠিল এবং পূর্ণ স্বাস্থ্য লাভ করিল।
এইরূপ ভাবে পীরে কামেল আস্তে আস্তে দুনিয়ার ভালবাসা ও সুখ-শান্তি হইতে নফছকে ফিরাইতে পারে এবং শেষ পর্যন্ত দুনিয়া তরক করিয়া চলিতে পারে এবং খাহেশাতে নফছানি হইতে মুক্তি পাইতে পারে। তারপর পবিত্র রূহ, যাহা মানবদেহে বাদশাহর ন্যায়, সে নফছ হইতে ফায়েদা লইতে পারে।
উপদেশ: যদি তোমার অন্তরের আবর্জনা ও ময়লা পরিষ্কার করিতে চাও, তবে পীরে কামেলের নিকট শিক্ষা গ্রহণ কর। তাঁহার আদেশ ও নিষেধ অনুযায়ী চলো। তিনি তোমার অন্তর অনুযায়ী তোমাকে শিক্ষা দিবেন এবং তুমি পবিত্র হইতে পারিবে।
নকদে হালে খেশেরাগার পায়ে বারেম,
হাম জে দুনিয়া হাম জে উকবা বর খুরেম।
অর্থ: মাওলানা বলেন, যদি আমি আমার বর্তমান অবস্থার কথা মনে করিয়া চিন্তা-ভাবনা করিতে থাকি, তবে আমি দুনিয়া ও আখেরাত হইতে উপকৃত হইতে পারিব।
ইঁ হাকিকাত রা শোনো আজ গোশে দেল,
তা বিরুঁ আই বে কুল্লি জে আবো গেল।
অর্থ: মাওলানা বলেন, এই ঘটনার হাকিকত অন্তঃকরণের কর্ণ দিয়া মনোযোগ সহকারে শুনো, তাহা হইলে তুমি তোমার জেঁছমানি (দৈহিক) কু-কাজ হইতে রেহাই পাইবে।
ফাহমে গেরদারিদ ও জাঁরা রাহ দেহিদ,
বাদে আজাঁ আজ শওকে পা দররাহে নাহিদ।
অর্থ: মাওলানা বলেন, মনের খেয়াল নিবিষ্ট করিয়া উৎসাহ সহকারে মনোযোগ দিয়া অনুধাবন করিতে চেষ্টা করো। অর্থাৎ, এই ঘটনা মনোযোগ সহকারে শুনিয়া ইহার অর্থ অনুধাবন করিয়া নিজের অবস্থার প্রতি লক্ষ্য করিয়া উহার প্রতিকারের চেষ্টায় লাগিয়া যাও।
বুদ শাহে দর জমানে পেশে আজ ইঁ,
মুলকে দুনিয়া বুদাশ ও মুলকে দীন।
অর্থ: মাওলানা ঘটনা বর্ণনা করিতেছেন যে, আমাদের পয়গম্বর (দঃ)-এর জামানার পূর্বে এক বাদশাহ ছিলেন। তিনি যেমন দুনিয়ার বাদশাহ ছিলেন, সেইরূপ ধর্মেরও বাদশাহ ছিলেন।
ইত্তেফাকান শাহ রোজে শোদ ছওয়ার,
বা আখওয়াছে খেশ আজ বহারে শেকার।
অর্থ: ঘটনাক্রমে বাদশাহ একদিন নিজ বন্ধু-বান্ধব নিয়া ঘোড়ায় সওয়ার হইয়া শিকার করিতে বাহির হইলেন।
বাহারে ছায়েদে মী শোদ উ-বর কোহো দাস্ত,
নাগাহানে দর দামে ইশ্কে উ-ছায়েদে গাস্ত।
অর্থ: শিকার করিতে যাইয়া একটি পাহাড়ের উপর চড়িলেন। হঠাৎ তিনি ইশকের জালে আবদ্ধ হইয়া পড়িলেন।
এক কানিজাক দিদ উ-বর শাহে রাহ,
শোদ গোলাম আঁ কানিজাক জানে শাহ।
অর্থ: বাদশাহ তাহার পথে এক সুন্দরী লাবণ্যময়ী দাসীকে দেখিতে পাইলেন এবং দাসীর প্রেমে বাদশাহর মন আবদ্ধ হইল। বাদশাহ উক্ত দাসীর আশেক হইয়া পড়িলেন।
মোরগে জানাশ দর কাফছ চুঁ দর তপিদ,
দাদে মাল ও আঁ কানিজাকরা খরিদ।
অর্থ: যেমন পাখি খাঁচার মধ্যে আবদ্ধ অবস্থায় পেরেশান থাকে, সেইরূপে বাদশাহর প্রাণ দাসীর জন্য ছটফট করিতে লাগিল এবং দাসীকে খরিদ করিয়া লইলেন।
চু খরিদ উরাও বর খোরদারে শোদ,
আঁ কারিজাক আজ কাজা বিমার শোদ।
অর্থ: যখন খরিদ করিয়া দাসী থেকে স্বাদ গ্রহণ করিতে আরম্ভ করিলেন, তখন খোদার মর্জিতে উক্ত দাসী রোগাক্রান্ত হইয়া পড়িল।
আঁ একে খার দাস্ত পালা নশ নাবুদ,
ইয়াফত পালান গরগে খাররা দর রেবুদ।
অর্থ: এক ব্যক্তি, তাহার গাধা আছে; কিন্তু সওয়ার হইবার পালং নাই। যখন পালং মিলিল, তখন গাধাকে নেকড়ে বাঘে বধ করিয়া নিয়া গেল।
কুজাহ বুদাম আব মী না আমদ বদস্ত,
আবরা চুঁ ইয়াফত খোদ কুজাহ শিকান্ত।
অর্থ: এক ব্যক্তির পানি পান করার পিয়ালা ছিল। কিন্তু পানি পাইতেছিল না। যখন পানি পাইল, তখন পিয়ালা ভাঙ্গিয়া গেল।
ভাব: উপরোক্ত দৃষ্টান্তদ্বয় দ্বারা বুঝা যায়, এই পৃথিবীতে কাহারো মনোবাসনা পূর্ণ হয় না।
শাহ তবিবানে জমায়া করদাজ চুপ ও বাস্ত,
গোফতে জান হর দো দর দস্তে শুমাস্ত।
অর্থ: বাদশাহ চতুর্দিক হইতে বিজ্ঞ হেকিম ও ডাক্তার তলব করাইয়া একত্রিত করিলেন এবং বলিলেন, আমাদের উভয়ের প্রাণ তোমাদের হাতে। অর্থাৎ, আমার এবং দাসীর প্রাণ বাঁচা না-বাঁচা তোমাদের চেষ্টার উপর নির্ভর করে।
জানে মান ছহলাস্ত জানে জানাম উস্ত,
দরদে মান্দো খাস্তাম দর মানামে উস্ত।
অর্থ: বাদশাহ বলেন, আমার প্রাণের মূল্য কিছুই নহে, প্রকৃতপক্ষে আমার প্রাণের প্রাণ ঐ দাসী-ই। যেমন নাকি আমি রোগ এবং দাসী ঔষধ।
হরকে দরমানে করদ মর জানে মরা,
বুরাদ গঞ্জো দোরবো মর জানে মরা।
অর্খ: যে ব্যক্তি আমার প্রাণকে সুস্থ করিয়া দিতে পারিবে, তাহাকে আমার মুক্তার ভাণ্ডার দান করিয়া দিব। (বাদশাহর প্রাণ সুস্থ করা অর্থ দাসীকে রোগমুক্ত করিয়া দেওয়া)
জুমলা গোফতান্দাশ কে জানে বাজি কুনেম,
ফাহম গেরদারেম ও আম্বাজী কুনেম।
অর্থ: সমস্ত ডাক্তার ও হেকিমগণ একত্রিতভাবে উত্তর করিলেন, আমরা প্রাণপণে চেষ্টা করিয়া ইহার চিকিৎসা করিব। প্রত্যেকে প্রত্যেকের সাথে যথাসাধ্য জ্ঞানের বিনিময় করিয়া একত্রিতভাবে চিকিৎসা করিব।
হরি একে আজ মা মছীহ আলমিস্ত,
হর আলমরা দর কাফেফ মা মরহামীস্ত।
অর্থ: হেকিমরা বলিলেন, আমরা প্রত্যেকেই এই যুগের মসীহ। অর্থাৎ, বিজ্ঞ ডাক্তার। প্রত্যেক রোগেরই ঔষধ আমাদের নিকট আছে।
গারখোদা খাহাদ না গোফতান্দ আজ বাতার,
পাছ খোদাবনামুদ শানে ইজ্জে বশার।
অর্থ: কিন্তু হেকিমেরা নিজেদের অহংকারের দরুণ খোদার নাম স্মরণ করে নাই, অর্থাৎ ইনশায়াআল্লা বলে নাই। খোদাতায়ালা তাহাদের চেষ্টা ব্যর্থ করিয়া দিয়াছেন। তাহারা অপারগ হইয়া ফিরিয়া গেল।
তরকে ইছতেছ না মুরাদাম কাছ ওয়াতিস্ত,
নায়ে হামী গোফতানকে আরেজে হালিস্ত।
অর্থ: ইনশায়াল্লাহ না বলার দরুণ তাহাদের কঠিন অন্তঃকরণ প্রমাণিত হইয়াছে। শুধু মুখ হইতে বলা আর না বলা যাহা ধরা যায় না, সেইভাবে হয় নাই।
আয়ে বছানাদর দাহ ইছ তিছনা বে গোফত,
জানে উ বা জানে ইছতিছ নাস্ত জোফত।
অর্থ: হে মানুষ, অনেক সময়ে ‘ইনশায়াল্লাহ’ মুখে না বলিলেও অন্তরে ইনশায়াআল্লাহ থাকে, অর্থাৎ ‘ইনশায়াল্লাহ’র অর্থ ও ভাব অন্তরে নিহিত থাকে এবং আল্লাহর উপর ভরসা রাখে, তাহাতেই আল্লাহ সন্তুষ্ট থাকেন। কিন্তু বিজ্ঞ ডাক্তার ও হেকিমরা নিজেদের দক্ষতার উপর ভর করিয়া অহঙ্কারে পরিপূর্ণ হইয়া আল্লাহর নাম ছাড়িয়া দিয়াছে।
হারচে করদান্দ আজ ইলাজ ও আজ দাওয়া,
গাস্ত রঞ্জে আফ জুঁ ও হাজত না রওয়া।
অর্থ: যতই ঔষধ ও দাওয়াই তদবীর করিয়াছেন, ততই রোগ বাড়িয়া চলিয়াছে। উদ্দেশ্য বিফল হইয়াছে। মানুষের চেষ্টা আল্লাহতায়ালা ব্যর্থ করিয়া দিয়াছেন।
শরবত ও দাওয়ায়ে ও আছবাবে উ,
আজ তবিবানে বুরাদ ইকছার আবরু।
অর্থ: রোগের যত প্রকার ঔষধ ও হেকিমী দাওয়া করা হইল, সমস্ত কিছুতেই ডাক্তার ও হেকীমগণের ইজ্জত গেল, কাহারও সম্মান বাকী রহিল না। সকলেই লজ্জিত হইয়া ফিরিয়া গেল।
আঁফানিজাক আজ মরজে চুঁমুয়ে শোধ,
চশমে শাহে আজ আশকে খুন ছুঁজুয়ে শোদ।
অর্থ: উক্ত দাসী রোগে কৃশ হইয়া চুলের ন্যায় হইয়া গিয়াছে। বাদশাহর অশ্রু রক্তে পরিণত হইয়া নহর হইয়া গিয়াছে, অর্থাৎ, বাদশাহ দাসীর শোকে কাঁদিতে কাঁদিতে তাঁহার নয়নের অশ্রু রক্তে পরিণত হইয়া প্রবাহিত হইতেছে।
চুঁ কাজা আইয়াদ তবিবে অবলাহ শওয়াদ,
আঁদাওয়া দর নাছে খোদ গোমরাহ শওয়াদ।
অর্থ: যখন খোদার নির্দেশ হইল, তখন তবিবগণ সকলেই বোকা বলিয়া প্রমাণিত হইল। ঔষধ-পত্র সকলই ক্রিয়াশূন্য মনে হইল।
আজ কাজা ছার কাংগবীন ছফরা ফজুদ,
রউগানে বাদামে খুশ কি মী নামুদ।
আজ হুলিয়া কবজে শোদ ইতলাকে রফত,
আব আতেশরা মদদ শোদ হামচু নাফাত।
অর্থ: বিজ্ঞ হেকিম ও ডাক্তারগণের চিকিৎসায় কোনো ফল লাভ হইল না। সে বিষয় উদাহরণ দিয়া মাওলানা বলিতেছেন যে, খোদার হুকুমে মাথায় চিরুনী করা সত্ত্বেও চুল এলোমেলো ও হলুদ বর্ণ থাকিয়া যায়। সুবাসিত বাদাম তৈল লাগান সত্ত্বেও চুল শুষ্ক হওয়া বৃদ্ধি পায়। ডাক্তারদের সর্বশক্তি বিফল গেল, এখন তাহাদের হাতে কোনো শক্তি নাই। রোগীর অবস্থা – যেমন আগুনে নাফাত নামক তৈল প্রাপ্ত হইয়াছে। (নাফাত এক প্রকার তৈল – স্প্রীটের ন্যায় আগুন জ্বলে)
ছুছতিয়ে দেল শোদ ফেজুঁ ও খাব কম,
ছুজাশে চশম ও দেল পুর দরদো গম।
বাদশাহর অবস্থা বর্ণনা করিতে যাইয়া মওলানা বলিতেছেন যে, দাসীর অবস্থা দেখিয়া বাদশাহ নিরাশ হইয়া পড়িয়াছেন এবং আহার-নিদ্রা ত্যাগ করিয়াছেন, অন্তর ও চক্ষু জ্বালা-যন্ত্রণায় পরিপূর্ণ হইয়া গিয়াছে।
হেকীমগণের দাসীর চিকিৎসায় অপরাগতা প্রকাশ পাওয়ায় বাদশাহর অবশেষে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করা ও স্বপ্নে এক অলির সাক্ষাৎ লাভ করা এবং নিজের বিপদ হইতে মুক্তি পাওয়া।
শাহ চু ইজ্জে আঁ তবিবান রা বদীদ,
পা বরহেনা জানেবে মাছজীদ দাওবীদ।
অর্থ: বাদশাহ যখন হেকীমদিগকে চিকিৎসায় অপারগ দেখিলেন, তখন খালি পদে খোদার মসজিদের দিকে দৌড়াইয়া গেলেন।
বকত দর মাছজিদে ছুয়ে মিহরাব শোদ,
ছিজদাহ গাহ আজ শকে শাহ পুর আবে শোদ।
অর্থ: বাদশাহ মসজিদে যাইয়া মিহরাবের মধ্যে সেজদায়ে পতিত হইয়া এমনভাবে খোদার নিকট কাঁদিতে লাগিলেন যে, সেজদার জায়গা বাদশাহর অশ্রুজলে ভাসিয়া গেল।
চুঁব খশে আমদ জে গরকাবে ফানা,
খোশ জবান ব কোশদ দর মদেহ ও ছানা।
অর্থ: বাদশাহ কাঁদিতে কাঁদিতে বেহুশ হইয়া গিয়াছিলেন। যখন হুশ আসিল, তখন উঠিয়া আল্লাহর গুণ-গান ও প্রশংসা করিতে লাগিলেন।
কাসে কমিন বখশিশাস্ত মুলকে জাহাঁ,
মানচে গুইয়াম চুঁ তুমি দানি নেহাঁ।
অর্থ: বাদশাহ বলিতেছেন, হে খোদা! তুমি যে আমাকে দুনিয়ার বাদশাহী দান করিয়াছ, ইহা তোমার পক্ষে নগণ্য দান। আমি যাহা বলিতেছি, তুমি ইহার প্রকৃত রহস্য জানো।
হালেমা ও ইঁ তবিবানে ছার বছার,
পেশে লুতফে আমে তু বাশদ হাদর।
অর্থ: আমার এবং হেকিমগণের অবস্থা, অর্থাৎ, আমি এবং হেকিমগণ যে তোমার উপর ভরসা করি নাই, ইহা তোমার নিকট মহা পাপের কাজ বলিয়া প্রমাণিত হইয়াছে। আমাদের উভয়ের চেষ্টা তোমার সাধারণ দানের সম্মুখে ব্যর্থ হইযাছে। আমি শাস্তি ভোগ করার উপযুক্ত হইয়াছি। তুমি যদি দয়া করিয়া ক্ষমা করিয়া দাও, তবে ইহা তোমার পক্ষে কিছুই নহে। ক্ষমা করা তোমার পক্ষে অতি সহজ।
আঁয়ে হামেশা হাজতে মারা পানাহা,
বারে দিগার মা গলতে করদেম রাহ।
অর্থ: বাদশাহ আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করিয়া ক্ষমা চাহিতেছেন; বলিতেছেন, হে খোদা, তুমি আমার সব সময়ের জন্য আশ্রয়স্থান। যদিও আমি বারংবার ভুল করিয়া পথভ্রষ্ট হইয়া থাকি, তথাপিও তোমার আশ্রয় ছাড়া আমার কোনো ভরসা নাই।
লেকে গুফতি গারচে মী দানেম ছারাত,
জুদে হাম পয়দা কুনাশ বর জাহেরাত।
অর্থ: বাদশাহ আল্লাহকে সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন, হে খোদা, তুমিই তো বলিয়াছ যে আমি সবারই রহস্যভেদ জ্ঞাত আছি। তবে আমার নিজের অন্তরের ব্যথা প্রকাশ্যে মুখ দিয়া বর্ণনা করার আবশ্যক মনে করি না। কিন্তু, তুমি বান্দাদিগকে তোমার নিকট প্রকাশ করিয়া বলার জন্য আদেশ করিয়াছ, তাই আমি প্রকাশ করিলাম।
চুঁ বর আওরদ আজ মিয়ানে জানো খোরোশ,
আন্দর আমদ বহরে বখশায়েশে বজোশ।
অর্থ: যখন বাদশাহ কান্নাকাটি করিয়া চুপ হইয়া তন্দ্রায় নিমগ্ন হইলেন, তখন আল্লাহতায়ালা রহমতের জোশ আসিয়া বাদশাহকে ক্ষমা করার খোশ-খবরি দান করিলেন।
দর মিয়ানে গেরিয়া খাবাশ দর রেবুদ,
দিদে দর খাবে উকে পীরে রো নামুদ।
গোফতে আয়শাহ মুশদাহ হাজতাত রওয়াস্ত,
গার গরিবি আইয়েদাত ফরদাজ মাস্ত।
অর্থ: বাদশাহ যখন কান্নার মধ্যে নিদ্রায় স্বপ্ন দেখিতেছিলেন, তখন দেখিলেন যে একজন বৃদ্ধ পীর তাঁহার সম্মুখে হাজির হইলেন এবং বলিলেন, হে বাদশাহ! তোমার বাসনা পূর্ণ হইয়া গিয়াছে। যদি কোনো মুসাফির আগামীকাল আমার তরফ হইতে তোমার সম্মুখে আসে, তবে তাহাকে সত্য বিজ্ঞ হেকিম বলিয়া মনে করিও।
চুঁকে উ আইয়াদ হাকীমে হাজে কাস্ত,
ছাদেকাশ দাঁ কো আমিন ও ছাদেকাস্ত।
দর ইলাজাশ ছেহরে মতল করা বা বিনি,
দর মেজাজশ কুদরাতে হকরা বা বিনি।
অর্থ: কেননা, তিনি একজন সুনিপূণ বিজ্ঞ হেকিম আসিবেন। তাঁহাকে সত্য বলিয়া জানিও, তিনি একজন আমানাতদার ও সত্যবাদী।
তাঁহার চিকিৎসার ব্যবস্থায় তুমি যাদুমন্ত্রের ন্যায় উপকার পাইবে। ঐ তবিবের মেজাজে ও কার্যে আল্লাহর কুদরাতের নমুনা দেখিতে পাইবে। তাঁহার চিকিৎসায় তোমার রোগী সুস্থ হইয়া উত্তম স্বাস্থ্য লাভ করিবে।
খোফতাহ বুদ ইঁ খাবে দিদে আগাহ শোদ,
গাস্তাহ মামলুকে কানিজাক শাহেশোদ।
অর্থ: বাদশাহ নিদ্রিত অবস্থায় এই স্বপ্ন দেখিয়া খুশি হইলেন। এতদিন পর্যন্ত দাসীর চিন্তায় নিমগ্ন ছিলেন, এখন চিন্তামুক্ত হইলেন।
চুঁ রছিদ আঁ ওয়াদাহগাহ ও রোজে শোদ,
আফতাব আজ শরকে আখতার ছুজেশোদ।
অর্থ: যখন ওয়াদা পূরণের দিন আসিয়া উপস্থিত হইল, সেইদিন ভোরে তিনি দেখিলেন, সূর্যের চাইতেও উজ্জ্বল চেহারাবিশিষ্ট এক ব্যক্তি উপস্থিত হইলেন।
বুদ আন্দর মানজারাহ শাহ মোন্তাজের,
তা বা বীনাদ আঁচে নামুদান্দ ছার।
অর্থ: বাদশাহ অপেক্ষার পর অপেক্ষা করিতেছিলেন, তারপর দেখিলেন যে তিনি প্রকাশ্যে উপস্থিত হইয়াছেন।
দীদে শখছে ফাজেলে পুর মায়ায়ে,
আফতাবে দরমিয়ানে ছায়ায়ে।
অর্থ: বাদশাহ দেখিলেন যে, এক ব্যক্তি মারেফাতে পূর্ণ কামেল এবং দেখিতে সূর্যের চাইতেও অধিক জ্যোতির্ময় চেহারাবিশিষ্ট ব্যাক্তি উপস্থিত হইলেন।
মী রছিদ আজ দূরে মানেন্দে হেলাল,
নীস্তে বুদো হাস্তে বর শেকলে খেয়াল।
অর্থ: মনে হইল যেন তিনি বহুদূর হইতে চাঁদের ন্যায় উদিত হইলেন। যেমন কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির খেয়াল মনে করিয়া লোক অপেক্ষায় থাকে, সেই রকম অবিদ্যমান খেয়ালী ব্যক্তি যদি আসিয়া উপস্থিত হয়, তখন মানুষের খুব আনন্দ হয়। বাদশাহ সেই রকম আনন্দিত হইলেন।
বর খেয়ালে ছুলেহ শাঁ ও জংগে শাঁ,
ওয়াজ খিয়ালে ফখরে শাঁ ও নংগে শাঁ।
অর্থ: যেমন, যদি কেহ ভাল মনে করিয়া সুলেহ (সন্ধি) করে, আর যদি কোনো কারণে যুদ্ধ আবশ্যক মনে করে, তবে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়। যদি কোনো কৃতিত্বের কথা মনে পড়ে, তবে ফখর করিতে আরম্ভ করে এবং যদি কোনো দুর্নামের কথা ভাবে, তবে লজ্জিত হয়।
আঁ খেয়ালাতে কে দামে আওলিয়াস্ত,
আকছে মহ রোবিয়ানে বুস্তানে খোদাস্ত।
অর্থ: এখানে মাওলানা লোকের খেয়ালের কথা বর্ণনা করিতে যাইয়া বলিতেছেন যে, কোনো লোকের খেয়াল বৃথা বলিয়া প্রমাণিত হয়। কিন্তু আওলিয়া লোকের খেয়াল কখনও মিথ্যা বা বৃথা প্রমাণিত হয় না। কেননা, তাঁহারা অন্তরকে মোরাকাবা ও মোকাশাফা দ্বারা পরিষ্কার করিয়া ফেলেন। তৎপর আল্লাহর তরফ হইতে সব কিছুর ইলহাম (ঐশী প্রত্যাদেশ) তাঁহাদের অন্তরে পতিত হয়। আল্লাহর ইলম হইতে তাঁহাদের অন্তরে ইলমে গায়েবীর প্রতিবিম্ব হয়, সেই খেয়াল মোতাবেক তাঁহারা কাজ করেন ও কথা বলেন। এইরূপ বিদ্যাকে ইলমে লাদুন্নী বলা হয়।
আখেঁয়ালেরা কে শহদর খাবে দীদ,
দররুখে মেহমান হামী আমদ পেদীদ।
অর্থ: বাদশাহ স্বপ্নে যে সমস্ত আলামত দেখিয়াছিলেন, এই আগন্তুকের চেহারায় সেই আলামতসমূহ বিদ্যমান ছিল।
নূরে হক জাহের বুদান্দ রুয়ে,
নেক বিঁ বাশি আগার আহালে দেলে।
অর্থ: আগন্তুকের চেহারায় আল্লাহর নূর প্রকাশ পাইতেছিল। যদি তুমি নেককার ও নির্মল অন্তরসম্পন্ন হও, তবে উক্ত নূর দেখিতে পাইবে। আল্লাহর ওলির চেহারায় আল্লাহর নূর চমকিতে থাকে।
আঁ ওয়ালিযে হক চু পযদা শোদ জে দূর,
আজ ছার আ পায়েশ হামী মীরিখত নুর।
অর্থ: ঐ প্রকৃত ওলি যখন দূর হইতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন, তাঁহার আপাদমস্তকে আল্লাহর নূর চমকিতে ছিল।
শাহ বজায়ে হাজে বানে দর পেশে রফত,
পেশে আঁ মেহমানে গায়েবে খেশ রফত।
অর্থ: বাদশাহ দারওয়ানের ন্যায় অভ্যর্থনা করার জন্য গায়েবী দরবেশের সম্মুখে উপস্থিত হইলেন।
জাইফে গায়েবী রা চুঁ ইছতেক বাল করদ,
চুঁ শোফার গুইকে পেওস্ত উ বা ওয়ারদ।
অর্থ: বাদশাহ যখন গায়েবী মেহমানের অভ্যর্থনা জানাইলেন, তখন এমনভাবে মিলিত হইলেন, যেমন চিনি দুধে মিশিয়া যায়; অথবা যেমন গোলাপ ফুল একটির সাথে অন্যটি মিলিয়া থাকে, সেইরূপ উভয় আল্লাহর অলি মিশিয়া গেলেন। কেননা, বাদশাহ-ও আল্লাহর অলি ছিলেন।
আঁ একে লবে তেশনা দাঁ দিগার চুঁ আব,
আঁ একে মাহমুজ দাঁ দিগার শরাব।
অর্থ: এখানে মাওলানা উভয়ের মিলনের কারণ বর্ণনা করিয়াছেন যে, তাঁহারা একজন অর্থাৎ বাদশাহ তৃষ্ণার্ত ছিলেন এবং মেহমান পানিস্বরূপ ছিলেন। একে অন্যের দিকে মুখাপেক্ষী ছিলেন। যখন প্রাপ্ত হইলেন, মিলিয়া গেলেন।
হরদো বহরে আশনা আমুখতাহ,
হরদো জানে বে দোখতান বর দোখতাহ।
অর্থ: এখানে মাওলানা উভয়ের ইলমে মারেফাত হাসিলের বর্ণনা দিয়া বলিতেছেন যে, তাঁহারা উভয়েই মারেফাতের সাগর ছিলেন। উভয়ের প্রাণ একে অন্যের সাথে এমনভাবে মিলিত ছিল, যেমন সেলাই ব্যতীত মিলিত রহিয়াছে।
গোফতে মায়া শুকাম তু বুদাস্তি না আঁ,
লেকে কারে আজ কারে খীজাদ দর জাহাঁ।
অর্থ: বাদশাহ মেহমানকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, আপনি-ই আমার প্রকৃত মাশুক ছিলেন, উক্ত দাসী নয়। কিন্তু, এই পৃথিবীতে অসিলা ব্যতীত কোনো কাজ সফল হয় না বলিয়া উক্ত দাসীকে প্রকাশ্যে ভালোবাসিয়াছিলাম। ঐ দাসীর অসিলায় আপনাকে পাইলাম। নতুবা আপনাকে পাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।
আয়ে মরা তু মোস্তফা মান চুঁ ওমর,
আজ বরায়ে খেদ মাতাত বান্দাম কোমর।
অর্থ: বাদশাহ মেহমানকে বলিলেন, হে বন্ধু! তুমি আমার নিকট হজরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর ন্যায় মুরশেদ, আর আমি হজরত ওমর (রাঃ)-এর ন্যায় খাদেম।
আল্লাহর অলির সহিত সর্বদা আদবের সাথে ব্যবহার করা ও বেয়াদবি করার কুফল সম্বন্ধে বর্ণনা
আজ খোদা জুইয়াম তাওফিকে আদব,
বে আদব মাহরুম গাশত আজ লুৎফে রব।
অর্থ: মাওলানা বলিতেছেন, খোদার নিকট আমি আদব শিক্ষার শক্তি কামনা করিতেছি। কেননা, বে-আদব আল্লাহর মেহেরবাণী হইতে বঞ্চিত থাকে।
ভাব: বাদশাহ আগন্তুক আল্লাহর অলির সাথে আদবের সহিত ব্যবহার করিয়াছেন বলিয়া আল্লাহর মেহেরবানী প্রাপ্ত হইয়াছেন। অতএব, আমাদেরও উচিত অলি-বুযূর্গের সাথে আদব সহকারে চলাফেরা করা। বে-আদবি করিলে আল্লাহর রহমত হইতে বঞ্চিত হইতে হয়। বালা-মুসিবতে গ্রেফতার হইতে হয়।
বে-আদব তনহা না খোদরা দাস্ত বদ,
বলকে আতেশ দরহামা আফাক জাদ।
অর্থ: বে-আদব শুধু নিজেরই ক্ষতি করে না, বরং সমস্ত দেশেই বে-আদবির আগুন ছড়াইয়া পড়ে। অর্থাৎ, বে-আদবির কুফল আগুনস্বরূপ। উক্ত আগুন সমস্ত দেশ জ্বালাইয়া পোড়াইয়া দেয়।
ভাব: যদি কোনো আল্লাহর অলির সাথে কেহ বে-আদবি করে, তবে ঐ দেশে যে বালা-মুসিবত পড়ে, উহা হইতে কেহ রেহাই পায় না। ভাল-মন্দ, নেককার-বদকার সকলেই বিপদগ্রস্ত হইয়া পড়ে। হয়তো কাহারও জন্য পরীক্ষাস্বরূপ; আর বদকারের জন্য গজব। কিন্তু কেহই উক্ত বালা হইতে রেহাই পাইবে না।
মায়েদাহ আজ আছমান দরমী রছিদ,
বেশারাও বায়ে ওবে গোফতও শনিদ।
অর্থ: যেমন হজরত মূসা (আ:)-এর যুগে আল্লাহতায়ালা মেহেরবানী করিয়া বনি ইসরাইলদের জন্য বিনা মেহনতে ও বিনা ক্রয়-বিক্রয়ে মান্না ও সালওয়ার খাঞ্চা নাজেল হইত। উহার সহিত বেয়াদবি করার ফলে আল্লাহতায়ালা খাঞ্চা পাঠানো বন্ধ করিয়া দিলেন।
দরমিয়ানে কওমে মুছা চান্দে কাছ,
বে-আদব গোফতান্দ কোছির ও আদাছ।
অর্থ: কয়েকজন লোকে বে-আদবির সাথে বলিয়াছিল, আমরা মান্না ও সালওয়ায়ে সন্তুষ্ট নহি। আমরা পেঁয়াজ, রসুন ও মশুর ডাল ইত্যাদি চাই। ইহাতে খোদার দানের প্রতি বেয়াদবি করা হইয়াছে বলিয়া আল্লাহতায়ালা মান্না-সালওয়া বন্ধ করিয়া দিলেন। এই ঘটনা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ আছে।
মুনকাতে শোদ খানো নানে আজ আছমাঁ,
মানাদ রঞ্জে জেরাও বেলও বেলও দাছেমাঁ।
অর্থ: আসমান হইতে মান্না ও সালওয়া নাজেল হওয়া বন্ধ হইয়া গেল। রইলো শুধু কাস্তে-কোদাল দিয়া কৃষি খামার করিয়া খাইবার কষ্ট। বিনা কষ্টে আর খাইতে পারিবে না।
বাজে ঈসা চুঁ শাফায়াত করদে হক,
খানে ফেরেস্তাদ ও গণিমাত বর তরক।
অর্থ: বহুদিন পর হজরত ঈসা (আ:)-এর যুগে, ঈসা (আ:)-এর শাফায়াতের কারণে খাঞ্চা নাজেল হওয়ার দোওয়া কবুল হইল এবং পুনরায় গণিমাত ও খাঞ্চা জমিনে নাজেল হইল।
মায়েদাহ আজ আছমান শোদ আয়েদাহ,
চুঁকে গোফত আনজেল আলাইনা মায়েদাহ।
অর্থ: পুনঃ ঐ খাঞ্চা আসমান হইতে নাজেল হইল। যখন ঈসা (আ:) আল্লাহর দরবারে দোওয়া করিলেন, হে খোদা, আমাদের উপর তুমি পুনঃ মান্না ও সালওয়া নাজেল করো।
বাজে গোস্তেখানে আদব ব গোজাস্তান্দ,
চুঁ গাদায়ানে জোলহা বর দাস্তান্দ।
অর্থ: ফের বেয়াদবরা বেয়াদবি করিলে খাঞ্চা নাজেল হওয়া বন্ধ হইয়া গেল। কারণ, তাহারা খাওয়ার পর যে খানা বাকি থাকিত, উহা উঠাইয়া রাখিয়া জমা করিত। খোদার তরফ থেকে হুকুম ছিল যে, বাকি খানা ইয়াতীম মিসকীনের মধ্যে বিতরণ করিয়া দিও। কিন্তু, তাহারা উহা নিজেদের জন্য জমা করিয়া রাখিত।
করদে ঈছা লাবা ইঁশাঁ রাকে ইঁ,
দাযেমাস্ত ও কম না গরদাদ আজ জমিন।
অর্থ: হজরত ঈসা (আ:) তাহাদিগকে অতি বিনয় সহকারে বুঝাইয়া দিলেন যে, এই খাঞ্চা তোমাদের জন্য সব সময় নাজেল হইবে। তোমরা উহা হইতে উঠাইয়া রাখিয়া জমা করিও না।
বদগুমানী করদান ও হেরচে আওয়ারী,
কুফরে বাশদ পেশে খানে মাহতারি।
অর্থ: খাঞ্চা নাজেল হয়, কিন্তু তাহারা খারাপ ধারণা করিল যে আগামীতে এই খাঞ্চা নাজেল হয় কিনা সন্দেহ। এই কারণে লোভে পড়িয়া কিছু কিছু জমা করিতে লাগিল। খোদার দান খাঞ্চার উপর সন্দেহ করায় কুফরি করা হইল। খোদার ওয়াদার উপর তাহাদের বিশ্বাস স্থাপন করা হইল না। এইজন্য কাফের হইতে খোদার নেয়ামত উঠাইয়া নেওয়া হইল।
জাঁ গাদা রুইয়ানে নাদিদাহ জাজ,
আঁদরে রহমতে বর ইঁশাঁ শোদ ফরাজ।
অর্থ: ঐ কারণে লোভীদের নাফরমানীর জন্য সকলের উপর খাঞ্চা নাজেল হওয়া বন্ধ হইয়া গেল। চিরদিনের জন্য এই পৃথিবীতে খোদার তরফ হইতে রহমতের খাঞ্চা নাজেল বন্ধ হইয়া গেল।
মান্না ছালওয়া জে আছমান শোদ মুনকাতেয়,
বাদে আজাঁ জানে খান নাশোদ কাছ মুন্তাফেয়।
অর্থ: মান্না সালওয়া আসমান হইতে নাজেল হওয়া বন্ধ হইয়া গেল। ইহার পর কাহারও জন্য ঐ খাঞ্চা হইতে উপকৃত হওয়া আর ভাগ্যে জোটে নাই।
আবর না আইয়াদ আজ পায়ে মানা জাকাত,
ওয়াজ জেনা উফতাদ ওবা আন্দর জেহাদ।
অর্থ: যেমন হাদীসে বর্ণনা করা হইয়াছে যে যখন লোকে যাকাত দেওয়া বন্ধ করিয়া দিবে, তখন ঐ দেশে আর আল্লাহর রহমতের মেঘ বর্ষণ হইবে না। আর যে দেশে জেনা (অবৈধ যৌনাচার) প্রচলন হইবে, সেখানে প্লেগ, কলেরা ও বসন্ত মহামারীরূপে দেখা দিবে।
হরচে আইয়াদ বর তু আজ জুলমাত ও গম,
আঁজে বেবাকী ও গোস্তাখী ইস্ত হাম।
অর্থ: যাহা কিছু তোমাদের উপর বিপদ-মুছিবত আসে, উহা তোমাদের নাফরমানী ও বেয়াদবির দরুন আসে। কিন্তু কতক লোকের নাফরমানীর দরুন সর্বসাধারণের উপর বালা আসিয়া পড়ে।
হরকে বেবাকী কুনাদ দর রাহে দোস্ত,
রাহজানে মরদানে শোদ ও নামরদা উস্ত।
অর্থ: যে ব্যক্তি আহকামে শরীয়াতের মধ্যে নাফরমানী ও বেয়াদবি করে, সে ব্যক্তি ডাকাতের ন্যায় কাপুরুষ।
হরকে গোস্তাখী কুনাদ আন্দর তরীক,
গরদাদ আন্দর ওয়াদীয়ে হাচরাত গরীক।
অর্থ: যে ব্যক্তি মারেফাতের তরীকার মধ্যে বেয়াদবি ও গোস্তাখি করে, সে সর্বদা দুঃখপূর্ণ কূপে ডুবিয়া থাকে। জীবনে কখনও শান্তি পায় না।
আজ আদান পুরনূর গাস্তাস্ত ইঁ ফালাক,
ওয়াজ আদাবে মায়াছুম ও পাক আমদ মালাক।
অর্থ: আসমান খোদার সম্মুখে আদব আদায় করার দরুন আল্লাহতায়ালা তাহাকে চন্দ্র, সূর্য ও তারকারাজি দ্বারা সুসজ্জিত করিয়া দিয়াছেন এবং ফেরেস্তারা ইলমে আসমা পরীক্ষার সময় আদবের সহিত উত্তর করায় তাহাদিগকে বে-গুণাহ করিয়া দিয়াছেন।
বদজে গোস্তাখী কুছুফে আফতাব,
শোদ আজাজিলে জে জুরায়াতে রদ্দে বাব।
অর্থ: বদলোকের গুণাহের দরুন সূর্যগ্রহণ হয়। আজাজিল অহঙ্কারের দরুন মরদুদ শয়তানে পরিণত হইয়া আল্লাহর দরবার হইতে বিতাড়িত হয়।
হালে শাহ ও মেহমানে বর গো তামাম,
জাঁকে পায়ানে না দারাদ ইঁ কালাম।
অর্থ: আদবের ফজিলত ও বেয়াদবির দুরবস্থার বর্ণনার সীমা নাই। এখন বাদশাহ ও আগন্তুক মেহমানের ঘটনা বর্ণনা করা দরকার।
(বাদশার ওলির সহিত সাক্ষাৎ করা, যে ওলিকে তিনি স্বপ্নে দেখিয়াছিলেন।)
শাহ চুঁ পেশে মেহমানে খেশে রফত,
শাহেবুদ ওয়ালেকে বাছ দরবেশ রফত।
অর্থ: বাদশাহ যখন নিজের মেহমানের সম্মুখে গেলেন, তখন তিনি যদিও বাদশাহ ছিলেন, তবু ফকিরানা ভাবে অতি বিনয়ের সতি সাক্ষাৎ করিলেন।
দাস্তে বকোশাদ ও কেনারা নাশ গেরেফত,
হামচু ইশকে আন্দর দেল ও জানাশ গেরেফত।
অর্থ: যখন বাদশাহ মেহমানের সম্মুখে গেলেন, যাওয়া মাত্র উভয় হাত দ্বারা মেহমানকে জড়াইয়া ধরিয়া কোলাকুলি করিলেন। যেমন ইশককে দেল ও জানের মধ্যে স্থান দেয়। অর্থাৎ, মেহমানকে অন্তরাত্মা দিয়া ভালোবাসিয়া ফেলিলেন।
দস্তো ও পে শানিয়াশ বুছিদান গেরেফত,
ওয়াজ মোকামে ওরাহে পুরছিদান গেরেফত।
অর্থ: বাদশাহ মেহমানের হাত ও কপালে চুম্বন করিতে আরম্ভ করিলেন। কোথা হইতে কোন্ পথে আসিয়াছেন জিজ্ঞাসাবাদ করিতে লাগিলেন।
পোরছ পরিছানে মী কাশিদাশ তা বা ছদর,
গোফতে গঞ্জে ইয়াফ তাম আখের বা ছবর।
অর্থ: জিজ্ঞাসাবাদ করিতে করিতে বাদশাহ মেহমানকে লইয়া সিংহাসনে যাইয়া উপস্থিত হইলেন এবং মেহমানকে বলিলেন যে, আমি আমার ধৈর্যের দরুন আমার মূলধনের খাজিনা পাইয়াছি।
ছবর তলখো আমদ ওয়ালেকিন আকেবাত,
মেওয়া শিরিন দেহাদ পুর মোনফায়াত।
অর্থ: ধৈর্য ধারণ করা যদিও কষ্টকর, কিন্তু উহার শেষফল অত্যন্ত উপকারজনক মিষ্টি ফল-স্বরূপ।
গোফতে আয়ে হাদিয়ায়ে হক ও দাফে হরজ,
মায়ানি আছ ছবরো মিফতাহুল ফরজ।
অর্থ: বাদশাহ মেহমানকে বলিতেছেন, হে আল্লাহর দান, আপনি আমার দুঃখ-কষ্ট দূরকারী। অর্থাৎ, ধৈর্য ধারণ করা-ই দুঃখ-কষ্ট দূর হওয়ার চাবিস্বরূপ।
আয়ে তাকায়ে তু জওয়াবে হর ছওয়াল,
মুশ কিল আজ তু হল্লে শওয়াদ বে কীল ও কাল।
অর্থ: বাদশাহ মেহমানকে বলিতেছেন, হে বরকতওয়ালা! আপনার সাক্ষাতে আমার প্রত্যেক বিপদ মুসিবত দূর হইয়া যাইবে। আমি কিছু বর্ণনা করিতেই আমার সমস্ত বিপদ ও মুসিবত আসান হইয়া যাইবে।
তরজ মানে হরচে মারা দর দেলাস্ত,
দস্তেগীর হরকে পায়াশ দর গেলাস্ত।
অর্থ: বাদশাহ বলেন, যাহা কিছু আমার অন্তরে আছে, উহা আপনি-ই নিজে বর্ণনা করিবেন। এবং আমি যে যে বিষয়ে বিপদগ্রস্ত আছি, আপনি-ই উহার সাহায্যকারী।
ভাব: আল্লাহর অলির নিকট প্রকাশ্যে কিছু বর্ণনা করা দরকার হয় না। কারণ, তাঁহারা আল্লাহর তরফ হইতে ইলহাম বা কাশফ দ্বারা সব কিছু মা’লুম করিয়া নিতে পারেন।
মারহাবা; ইয়া মোজতবা, ইয়া মোরতজা,
ইন তাগেব জায়াল কাজা দাকাল ফাজা।
অর্থ: হে পবিত্র ও প্রিয়! তোমার আগমন আমার আনন্দের বিষয়। তুমি যদি আমা হইতে দূর হইয়া যাও, তবে আমার মৃত্যু অনিবার্য এবং আমার ইহ-জীবন বৃথা।
আনতা মাওলাল কওমে মান লা ইয়াশতাহী,
কদর দে কাল্লা লা ইন লাম ইয়ান তাহী।
অর্থ: আপনি মানবের হিতাকাঙ্ক্ষী ও সাহায্যকারী। আপনার প্রতি যাহার আকাঙ্ক্ষা নাই, সে নিশ্চয় ধ্বংস হইয়া যাইবে।
ভাব: আল্লাহর অলিদের প্রতি ভালোবাসা ও মহব্বত রাখা চাই; না হইলে আল্লাহতায়ালা অসন্তুষ্ট হইয়া তাহার অবনতি ঘটান।
[বাদশাহ ঐ তবিবকে রোগীর নিকট নিয়া যাওয়া এবং রোগীর অবস্থা দেখা।]
চুঁ গোজাস্ত আঁ মজলেছ ও খানে করম,
দস্তে উ ব গেরেফত ও বোরদো আন্দর হেরেম।
অর্থ: কথাবার্তার পর খানা-পিনা শেষ করিয়া মেহমানকে নিয়া অন্দরমহলে চলিয়া গেলেন।
কেচ্ছা রঞ্জুর ও রঞ্জুরে ব খানাদ,
বাদে আজ আঁ দরপেশে রঞ্জুরশ নেশানাদ।
অর্থ: রোগীর রোগের কথা বর্ণনা করিয়া তারপর রোগীর নিকট তাঁহাকে বসাইয়া দিলেন।
রংগে রো ও নবজো কারুরা বদীদ,
হাম আলামাত ও হাম আছ বাবাশ শনীদ।
অর্থ: তবিব সাহেব রোগীর চেহারা, রং ও স্নায়ুর গতিবিধি পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন, এবং রোগের নমুনা ও কারণসমূহ শ্রবণ করিলেন।
গোফতে হর দারু কে ইঁশা করদান্দ,
আঁ ইমারাত নিস্ত বিরান করদন্দ।
অর্থ: পূর্বোক্ত ডাক্তার ও হেকিম সাহেবেরা রোগ চিনিতে পারেন নাই। অতএব, তাঁহারা যে ঔষধ প্রয়োগ করিয়াছেন, উহাতে বিপরীত ক্রিয়া করিয়াছে এবং তাহার অবস্থার আরও অবনতি ঘটিয়াছে।
বে খবর বুদান্দ আজ হালে দরুঁণ,
আস্তাইজল্লাহা মিম্মা ইয়াফতারুণ।
অর্থ: তবীব আরও বলিলেন, আগেকার ডাক্তার ও হেকীমগণ রোগীর অভ্যন্তরীণ অবস্থা বুঝিতে পারেন নাই। তাঁহারা যে বৃথা ঔষধপত্র করিয়াছেন, উহার জন্য আল্লাহর কাছে পানাহ চাহিতেছি।
দীদে রঞ্জ ও কাশফে শোদ বরওয়ায়ে নে হুফত,
লেকে নেহাঁ করদ ও বা ছুলতান না গোফত।
অর্থ: এই বিজ্ঞ তবীব রোগী দেখিলেন এবং রোগীর অভ্যন্তরীণ গুপ্ত রহস্য সম্বন্ধে অবগত হইলেন। রোগী কিন্তু রোগের অবস্থা গুপ্ত রাখিয়াছে। বাদশাহর কাছে বলে নাই।
রঞ্জাশ আজ ছাফরাও আজ ছওদা নাবুদ,
বুয়ে হর হিজাম পেদীদ আইয়াদ জেদুদ।
অর্থ: রোগীর রোগ হলুদ ও কাল মিশ্রিতের জন্য নয়, যেমন-প্রত্যেক কাষ্ঠের ঘ্রাণে কাঠের পরিচয় পাওয়া যায়; যখন উহা জ্বালায় তখন উহার ধূয়ার ঘ্রাণ নিলেই পরিচয় পাওয়া যায়।
দীদ আজ জারিয়াশ কো জারে দেলাস্ত,
তন খোশাস্ত আম্মা গেরেফতারে দেলাস্ত।
অর্থ: বিজ্ঞ তবীব ছাহেব দেখিলেন যে, রোগীর ক্রন্দনে তাহার অন্তরের ব্যথা প্রকাশ পায়। শরীর সুস্থ আছে কিন্তু অন্তরে ব্যথা নিহিত।
আশেকী পয়দাস্ত আজ জারীয়ে দেল,
নিস্তে বিমারী চুঁ বিমারিয়ে দেল।
অর্থ: প্রেমিক হওয়াটা অন্তরের ব্যথা। অন্তরের ব্যথার চাইতে কোনো বেদনা-ই কঠিন নহে।
ইল্লাতে আশেক জে ইল্লাত হায়ে জুদাস্ত,
ইশকে ইছতের নাবে আছরারে খোদাস্ত।
অর্থ: মাওলানা বলিতেছেন, প্রেমিক হওয়ার কারণ অন্যান্য রোগের কারণ হইতে পৃথক। প্রেমিক হওয়ার কারণ খোদার রহস্য ইশকের দরুন খোদার ভেদ জানা যায়।
আশেকী গার জিইঁ ছার ওগার জাআছারাস্ত,
আকেবাত মারা বদাঁ শাহ রাহ্ বরাস্ত।
অর্থ: মাওলানা বলেন, ইশক মাজাজী হউক, আর হাকিকী হউক, যে ভাবেই হউক না কেন শেষফল খোদাকে চেনা যায়। খোদার ভালোবাসা লাভ করা যায়। যেমন আমাদের অবস্থা। আমাদিগকে শেষ পর্যন্ত হক-তায়ালাকে পরিচিত করিয়া দিয়াছেন।
হরচে গুইয়াম ইশকেরা শরাহ ও বয়ান,
চুঁ বা ইশ্কে আইয়াম খজল বাশাম আজ আঁ।
অর্থ: মাওলানা বলেন, ইশক অনুভব করার বস্তু। অনুভূতির বস্তু লাভ করিতে বুঝ-শক্তি ও স্বাদ গ্রহণের শক্তি প্রখর হওয়া চাই। শুধু লিখনে ও বর্ণনায় যথেষ্ট নয়। তাই, আমি যখন ইশ্কের ব্যাখ্যা বর্ণনা করি, তখন নিজের অনুভূতির দিক দিয়া লজ্জিত হই। কারণ, ইশকের ব্যাখ্যা ও বর্ণনা যে পরিমাণেই করি না কেন, ইশকের গুণাগুণ ও স্বাদ তাহার চাইতে অধিক, তাই নিজে নিজে তখন লজ্জিত হই।
গারচে তাফছীরে জবান রৌশন গারাস্ত,
লেকে ইশ্ক বে জবান রৌশান তরাস্ত।
অর্থ: মাওলানা বলেন, যদিও প্রত্যেক বস্তুর মূল বৃত্তান্ত বর্ণনা দ্বারা প্রকাশ পায়, কিন্তু, ইশক বর্ণনা ব্যতীত বেশি প্রকাশ পায়। অনুভব করিলেই মর্যাদা বুঝিতে পারে।
চুঁ কলম আন্দর নাবেস্তান মী শেতাফত,
চুঁ বা ইশ্কে আমদ কলম বর খোদ শেগাফত।
অর্থ: কেননা, যখন কলম নিয়া অন্যান্য বিষয় লিখিতে বসি, তখন কলম খুব তাড়াতাড়ি চলে। আর যখন ইশক সম্বন্ধে লিখিতে আরম্ভ করি, তখন কলম নিজে নিজেই ফাটিয়া যায়, লিখা যায় না। অর্থাৎ, ইশকের ক্রিয়া এমন, যাহার কারণে লিখিতে বসিলেই কলম ফাটিয়া চৌচির হইয়া যায়। ইশক লিখার বস্তু নয়, অনুভব করার বস্তু (বিষয়)।
চুঁ ছুখান দর ওয়াছফে ইঁ হালত রছিদ,
হাম কলম বশেকাস্ত ওহাম কাগজ দরিদ।
অর্থ: যখন ইশক সম্বন্ধে বর্ণনার অবস্থা এইরূপ যে, লিখিতে বসিলে কলম ফাটিয়া যায় এবং কাগজ ছিঁড়িয়া যায়, তাই উহার বর্ণনা দেওয়া অসম্ভব। শুধু অনুভূতি শক্তি দ্বারা অনুভব করিতে হয়।
আকাল দর শরাহশ চু খরদর গেল বখোফত,
শরাহ ইশ্ক ও আশেকী হাম ইশক গোফত।
অর্থ: মাওলানা বলেন, জ্ঞান যখন ইশকের বর্ণনা করিতে অক্ষম – যেমন, গাধা কাদা-মাটিতে আটকাইয়া গেলে চলিতে অক্ষম; তাই ইশকের বয়ান ইশক নিজেই করিতে পারে। অর্থাৎ, ইশক যাহার অন্তরে হাসিল হয়, তাহাকে দেখিলেই ইশকের অবস্থা বুঝা যায়।
আফতাব আমদ দলিলে আফতাব,
গার দলিলাত বাইয়াদ আজওয়ায়ে রুমতাব।
অর্থ: মাওলানা আরও প্রমাণ পেশ করিয়া ইশকের রহস্য সম্বন্ধে দৃষ্টান্ত দিতেছেন যে, সূর্য উদিত হইলে সূর্য নিজেই তাহার প্রমাণ। যদি কেহ সূর্যের প্রমাণ চায়, তবে তাহাকে নিজেই বাহির হইয়া রৌদ্রের প্রখরতা অনুভব করিতে হইবে। অন্য কেহ তাহাকে বর্ণনা দিয়া বুঝাইতে পারিবে না। কেননা, সূর্য কেমন – এই প্রশ্নের উত্তর কেহ বর্ণনা দিয়া বুঝাইতে চেষ্টা করিলে সে কিছুতেই সূর্যের হাকিকাত বুঝিবে না। অতএব, তাহাকে বাহির হইয়া সূর্যের হাকিকাত অনুভব করিতে হইবে।
আজ ওয়ায়ে আর ছায়া নেশানে মী দেহাদ,
শামছো হরদমে নূরে জানে মী দেহাদ।
অর্থ: মাওলানা বলিতেছেন, জাহেরী সূর্য কোনো কোনো সময় গায়েব হইয়া যায়, তখন অন্ধকার আসে বা ছায়া পতিত হয়। কিন্তু, হাকিকী সূর্য সব সময়ে রূহকে আলো প্রদান করে।
ভাব: মাওলানা ইশকের তুলনা সূর্যের সাথে করিতে যাইয়া হঠাৎ সূর্য হইতে আল্লাহর নূরের দিকে ফিরিয়া গিয়াছেন এবং বলিতেছেন, সূর্যকে দেখিয়া সূর্যের প্রখরতা বুঝা যায়। আবার যখন গায়েব হইয়া যায়, তখন ছায়া আসে; উহা সূর্যকিরণের বিপরীত বা বিরুদ্ধ। এই বিরুদ্ধ দ্বারা সূর্যের প্রকৃত গুণাগুণ অনুভব করা যায়। কিন্তু হাকিকী সূর্য, অর্থাৎ, আল্লাহতায়ালা, তিনি আলোস্বরূপ। যেমন, তিনি নিজেই পবিত্র কালামে উল্লেখ করিয়াছেন, “আল্লাহ নূরুছ ছামাওয়াতে ওয়াল আরদে”। অর্থাৎ, আল্লাহতায়ালা আছমান জমিনের একটি আলো স্বরূপ। তাই মাওলানা আল্লাহকে হাকিকী আলো বলিয়াছেন। সেই আলো সূর্য হইতে পৃথক। কারণ, তিনি সর্বদা আরেফীনদের অন্তরে আলো দান করিতেছেন। কোনো সময়েই কোনো মুহূর্তে আলো দান করা বন্ধ হয় না। কিন্তু, সূর্য গায়েব হইয়া গেলে আলো দান হইতে বিরত থাকে। তাই মাওলানা বলেন, সূর্যের আলোর সাথে আল্লাহর আলোর তুলনা করা পরিপূর্ণভাবে ঠিক হয় না, যদিও আলো দান হিসাবে একই। সূর্যের আলো অস্থায়ী, অসম্পূর্ণ; আর আল্লাহর আলোর পরিপূর্ণ, স্থায়ী। সূর্যের বিরুদ্ধে ছায়া আছে, ছায়া দ্বারা সূর্যের হাকিকাত বুঝা যায়। কিন্তু, আল্লাহর কোনো বিরুদ্ধ নাই, যদ্বারা আল্লাহকে জানা যায়। আল্লাহকে জানিতে হইলে, তাঁহার নিজ গুণ দ্বারা জানিতে হইবে ও অনুভব করিতে হইবে। আল্লাহতায়ালা সদা সর্বদা ইহ-জগতে আলো দান করিতেছেন বলিয়া তাঁহাকে চিনা ও বুঝা সহজসাধ্য নয়। কেননা, পূর্বেই বলা হইয়াছে, তাঁহার বিরুদ্ধ নাই যে তাহা দ্বারা তাঁহাকে সহজে জানা যাইবে। আল্লাহকে পাইতে হইলে সূক্ষ্ম ও সতেজ অনুভূতি থাকা দরকার। সতেজ অনুভূতি শক্তি না থাকিলে আল্লাহকে পাওয়া যায় না।
ছায়া খাব আরাদ তোরা হামচুঁ ছামার,
চুঁ বর আইয়া শামছু ইনশাক্কাল কামার।
অর্থ: এখানেও মাওলানা সূর্য ও জাতে পাকের আলো দানের পার্থক্য সম্বন্ধে বলিতে যাইয়া বলিতেছেন যে, সূর্য যখন ডুবিয়া যায়, তখন পৃথিবীতে ছায়া ঘনাইয়া আসে এবং অন্ধকার হইয়া যায়। ঐ অন্ধকারে লোকের নিদ্রা আসে এবং কাজ-কারবার ত্যাগ করিয়া শুইয়া পড়ে। কিন্তু, জাতে পাকের আলো সব সময়ই আলো দান করিতেছেন। তাঁহার আলো দান বন্ধ হইলে বা পৃথিবী হইতে গায়েব হইয়া গেলে, ইহ-জগত কিছুতেই টিকিয়া থাকা সম্ভব হইত না। সৃষ্টি জগত সবই ধ্বংস হইয়া যাইত। জাতে পাক সব সময়ই বিদ্যমান, তাঁহার ভূত-ভবিষ্যৎ নাই। সর্বদা একই ভাবে আছেন ও চিরকাল থাকিবেন। তাই মাওলানা বলিতেছেন, সূর্যের ছায়া মানুষের অবশতা আনয়ন করিয়া নিদ্রায় নিমগ্ন করে। যেমন, রাজা-বাদশাহগণের কেচ্ছা-কাহিনী নিদ্রা আনয়ন করে। কিন্তু জাতে পাকের আলো কোনো সময়ই আলো দান হইতে বিরত থাকে না। যদি বিরত থাকিতেন, তবে ইহ-জগতের কিছুই বিদ্যমান থাকিত না। কেননা, নূরে ইলাহির প্রভাবে ইহ-জগতের সব কিছুই সৃষ্ট। যেমন, চন্দ্র সূর্য হইতে আলো প্রাপ্ত হইয়া আলোকিত হয়, তেমনি খোদার আলো পাইয়া সৃষ্ট জগতের সকলেই সৃষ্টি হইয়াছে। তাঁহার আলো না পাইলে কোন কিছুই সৃষ্টি হইতে পারিত না।
খোদ গরিবী দর জাহাঁ চুঁ শামছে নিস্ত,
শামছে জানে বাকী ইস্ত কোরা আমছে নিস্ত।
অর্থ: সূর্য পৃথিবীতে মুসাফিরের ন্যায় আসে এবং যায়। অর্থাৎ, প্রত্যহ সূর্য উদিত হয় এবং সন্ধ্যায় অস্ত যায়, সেই কারণে আজ আর কাল সৃষ্টি হয়। কিন্তু প্রকৃত সূর্য আল্লাহতায়ালা, তিনি কখনও অস্ত যান না। সর্বদা আছেন, সৃষ্টি জগতে সব সময় আলো দান করিতেছেন এবং সর্বদা অনন্তকাল পর্যন্ত থাকিবেন।
শামছো দর খারেজে আগার চে কাস্তে করদ,
মী তাওয়াঁ হাম মেছলে উ তাছবীরে করদ।
লেকে আঁ শামছি কে শোদ বন্দাশ আছির,
নাবুদাশ দর জেহেনো খারেজে নজীর।
অর্থ: যদিও পৃথিবীতে মাত্র একটি সূর্য দেখা যায়, কিন্তু উহা দ্বারা অনেক সূর্যের ছবি আঁকা যায়। কিন্তু হাকিকী সূর্য অর্থাৎ আল্লাহতায়ালা, যাহার অধীনস্থ ইহ-জগতের সূর্য, তাঁহার আকৃতি বা ছবি প্রকাশ্যে খেয়াল করা বা ছবি অঙ্কন করিয়া দেখান কখনও সম্ভব নহে।
দর তাছওর জাতে উরা গঞ্জে কো,
তা দর আইয়াদ দর তাছাওর মেছলউ।
অর্থ: আল্লাহতায়ালার জাতে পাকের ছবি অন্তরে অঙ্কন করা যায় না; তাই তাঁহার ন্যায় ছবি কোথায় পাইবে অর্থাৎ, সূর্যের ছবি সূর্যকে দেখিয়া অঙ্কন করা যায়, আর জাতে পাকে আল্লাহর আকৃতি অন্তরে বা জেহেনেও খেয়াল করা অসম্ভব, প্রকাশ তো দূরের কথা। অতএব, সূর্যের আলোর সাথে খোদার আলোর তুলনা করা খাটে না।
সামছে তিবরিজি কে নূরে মতলকাস্ত
আফতাবাস্ত ও জা আনওয়ারে হকাস্ত
অর্থ: এখানে মাওলানা নিজের তরিকার পীর মাওলানা সামছু্দ্দিন তিবরিজির প্রশংসা করিতেছেন, আমার মুরশেদ হজরত মাওলানা সামছদ্দিন তিবরিজি (রাঃ) এক সূর্যের ন্যায়। তাঁহার মধ্যে মারেফাতের আলো পরিপূর্ণ আছে। অর্থাৎ, তিনি একজন পূর্ণ কামেল ব্যক্তি। সূর্যের চাইতেও আলোতে তিনি পরিপূর্ণ। আল্লাহতায়ালা তাঁহাকে নূরে পরিপূর্ণ করিয়া দিয়া লোকের হেদায়েতের জন্য ইহ-জগতে পয়দা করিয়াছেন। অতএব, আমাদের উচিত তাঁহার নিকট হইতে ইলমে মারেফাত শিক্ষা করা।
চুঁ হাদীছ রুয়ে সামছুদ্দিন রছিদ,
সামছে চারাম আছমান চার দর কাশীদ।
অর্থ: যখন আমার ওস্তাদ সামছুদ্দিন তিবরিজির বর্ণনা প্রসঙ্গ আসিয়া পড়ে, তখন তাঁহার সম্মুখে আসমানের সূর্য লজ্জায় নত হইয়া যায়। কারণ, আকাশের সূর্য শুধু বাহ্যিক আলো দান করিতে পারে, আর আমার ওস্তাদ সামছু্দ্দিন বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীন উভয় দিকের আলো দান করিতে পারেন।
ওয়াজেব আমদ চুঁকে আমদ নামে উ,
শরাহ করদান রমজে আজ ইনয়ামউ।
অর্থ: যখন তাঁহার বর্ণনার কথা আসিয়া পড়িয়াছে, তখন তাঁহার কোনো কোনো দানের কথা উল্লেখ করা একান্ত দরকার।
ইঁ নাকাছে জানে দামানম বর তাফতাস্ত,
বুয়ে পিরাহামে ইউছুফ ইয়াফতাস্ত।
অর্থ: এই সময় আমার প্রাণ আমার আঁচল (দামন) ধরিয়া রাখিয়াছে এবং আমার মুরশেদের কিছু প্রশংসা করার জন্য আমার প্রাণ উৎসুক রহিয়াছে।
কাজ বরায়ে হক্কে ছোহবাত, ছালেহা,
বাজে গো রমজে আন্দাঁ খোস হালে হা।
অর্থ: কেননা, বহু বৎসর সোহবতে থাকিয়া যে সব নেয়ামত হাসেল করিয়াছি, তাহার কিছু প্রকাশ করিতে ইচ্ছা রাখি।
তা জমিনো আছেমাঁ খান্দাঁ শওয়াদ।
আকল ও রূহ দিদাহ ছদ চান্দাঁ শওয়াদ।
অর্থ: কেননা, ঐ সমস্ত নেয়ামতের রহস্য বর্ণনা করিলে সমগ্র জগৎ আলোকিত হইয়া যাইবে। অর্থাৎ, মারেফাতে ইলাহির রহস্য বর্ণনা করিলে জগতের মানুষের অন্তর্জীবন সঞ্চার করিয়া তাজা হইয়া উঠে। স্বয়ং মাওলানার নিজের অন্তরও উহা দ্বারা উন্নতি লাভ করিবে।
গোফতাম আয়ে দূরে উফতাদাহ আজ হাবিব,
হামচু বিমারে কে দূরাস্ত আজ তবীব।
লাতুকাল্লেকুলি ফা ইন্নি ফীল কানায়ে।
কেল্লাত আফহামী কালা আহছি ছানা।
অর্থ: মাওলানা বলেন, আমি আমার নিজের অন্তরকে বলিলাম, হে অন্তর, তুমি তোমার বন্ধু মুরশেদ হইতে দূরে আছ। যেমন – রোগী ডাক্তার হইতে দূরে থাকিলে রোগের যন্ত্রণা ভোগ করে, তেমন তোমার মাহবুব হইতে দূরে পতিত হইয়া যন্ত্রণা ভোগ করিতেছ। তাই তিনি নিজ অন্তরকে লক্ষ্য করিয়া বলিতেছেন, আমাকে কষ্ট দিও না; কেননা, আমি বে-খোদীতে মশগুল আছি। আমার বুদ্ধি ও আক্কেল লুপ্ত হইয়া গিয়াছে। সেই কারণে আমার মুরশেদের প্রশংসা করার মত শক্তি পাইতেছি না।
ভাব: মাওলানা এখানে নিজের পীরে কামেলের কথা স্মরণ করিয়া তাঁহার কামালাতের কথা মনে পড়ায় অস্থির হইয়া পড়িয়াছেন এবং সেই হেতু তিনি বলিতেছেন, আমি বে-খোদীতে মশগুল আছি, আমার মাহবুব মুরশিদের প্রশংসা করার মত শক্তি এখন নাই। অতএব, হে মন! আমাকে এখন আমার শক্তির বাহিরে কষ্ট দিও না।
কুল্লু শাইয়েন ফালাহু গাইরুল মুফিক,
ইন তাকাল্লাফ আও তাছাল্লাফ লা ইয়ালিক।
অর্থ: বেহুশ ব্যক্তি যে মর্ম ব্যক্ত করে, উহা অতিরিক্ত অথবা অনুপযুক্ত বলিয়া মনে হয়।
হরচে মী গুইয়াদ মোনাছেব চুঁ নাবুদ,
চুঁ তাকা্ল্লুফ নেকে নালায়েকে নামুদ।
অর্থ: কেননা, বে-হুশ ব্যক্তি যাহা কিছু বলে, সময় উপযোগী হয় না বলিয়া লোকে অতিরঞ্জিত বলিয়া মনে করে। গুরুত্বহীন মনে করিয়া অবহেলা করে।
মান চে গুইয়াম এক রগাম হুশইয়ারে নিস্ত,
শরাহ আঁ ইয়ারে কে উরা ইয়ারে নিস্ত।
অর্থ: মাওলানা বলেন, আমি এ মাহবুবের কী প্রশংসা করিব, যাহার কোনো উপমা বা তুলনা নাই; তাঁহার কোনো শরীকও নাই। অর্থাৎ, আমি যখন আমার মুরশিদের কথা স্মরণ করিয়া জ্ঞানহারা হইয়া পড়িয়াছি এবং যাহার কামালাতের অসিলায় আল্লাহর মহব্বত হাসেল করিয়াছি, তখন ঐ আল্লাহর প্রশংসা কেমন করিয়া করিব, যাহার কোনো তুলনা নাই।
শরহে ইঁ হেজরাণ ওইঁ খুনে জেগার,
ইঁ জমানে বুগজার তা ওয়াক্তে দিগার।
অর্থ: মাওলানা নিজের অপরাগতা প্রকাশ করিয়া বলিতেছেন, আমার সমস্ত ধমনীতে আল্লাহর মহব্বতের রক্ত প্রবাহিত আছে, সর্বদা আল্লাহর দিদারের জন্য মুখাপেক্ষী আছে। এই বিরহ বেদনার অবস্থাতে ইশকের রহস্য বর্ণনা করা আমার পক্ষে সম্ভব নহে, যদি পারি অন্য সময়ে বর্ণনা করিব।
কালা আতেয়েমনি ফা ইঁন্নি জায়েউন,
ওয়া আয়তাজেল ফাল ওয়াক্ত ছাইফুন কাতেয়ুন।
অর্থ: মাওলানা বলেন, আমার প্রাণ বলিল যে আমি ক্ষুধার্ত, আমাকে খাদ্য দাও। শীঘ্র করিয়া দাও; কেননা সময় তরবারিস্বরূপ কর্তনকারী।
ভাব: মাওলানা বলেন, আমি নিজে বে-খোদীতে মশগুল; ইশকের রহস্য বর্ণনা করার মত শক্তি আমার নাই। কিন্তু আমার প্রাণে মানে না। প্রাণ বলে, আমি ক্ষুধার্ত, পিপাসার্ত। আমি ইশকের স্বাদ গ্রহণ করিতে চাই। আমাকে অতি শীঘ্র স্বাদ গ্রহণ করিতে দাও। নতুবা, সময় চলিয়া গেলে আর পাওয়া যাইবে না। সময় অমূল্য ধন।
বাশদ ইবনোল ওয়াক্তে ছুফী আয়ে রফিক,
নিস্তে ফরদা গোফতান আজ শরতে তরিক।
অর্থ: মন মাওলানাকে আরো বলে, হে সূফী! তুমি যে অবস্থায় আছ, এখনই তোমার ইশকের রহস্য বর্ণনা করা দরকার। ইশকের পথিকের পক্ষে কালকের জন্য ওয়াদা করা বিধানসম্মত নয়। অতএব, এখনই বলিয়া ফেল। আগামীর জন্য অপেক্ষা করিও না। উহা তরিকার পরিপন্থী।
ছুফী ইবনোল হালে বাশদ দর মেছাল,
গারচে হরদো ফারেগে আন্দাজ মাহ ওছাল।
অর্থ: সুফীকে ইবনোল হালের সহিত তুলনা দিয়া বলা হইয়াছে। তাহা না হইলে উভয়ের মধ্যে বেশ পার্থক্য আছে। যেমন – মাস ও বৎসরের মধ্যে পার্থক্য আছে।
তু মাগার খোদ মরদে ছুফী নিস্তি,
নকদেরা আজ নেছিয়া খীজাদ নিস্তি।
অর্থ: মন মওলানাকে বলিতেছে, তুমি ক্ষান্ত দিয়া বসিলে, বোধ হয় তুমি সুফী আদমী নহো। বর্তমান সময়কে অন্য সময়ের জন্য ফেলিয়া রাখিলে তাহা না হওয়ার মধ্যে পরিগণিত হয়।
গোফতামাশ পুশিদাহ খোশতর ছেররে ইয়ার,
খোদ তু দর জিমনে হেকায়েত গোশেদার।
অর্থ: মাওলানা বলেন, আমি আমার মনকে উত্তর দিলাম যে যদিও সময়ের মূল্য অনুধাবন করা একান্ত দরকার, কিন্তু উহার চাইতেও বেশী লক্ষ্য রাখা দরকার হিকমাতের দিকে।
খোশতর আঁ বাশদ কে ছেররে দেল বরাঁ,
গোফতা আইয়াদ দর হাদীছে দীগারাঁ।
অর্থ: মাশুকের ইশকের ভেদ অন্য রকম ঘটনা ও উদাহরণ দ্বারা বর্ণনা করা অতি উত্তম।
গোফতে মকশুফ বরহেনা বেগলুল,
বাজে গো দফয়াম মদেহ আয় আবুল ফজল।
অর্থ: মাওলানা বলেন, আমার অন্তর আমাকে বলিল যে তুমি ইশকের রহস্য প্রকাশ করিয়া বল, কোনো অংশ গোপন করিও না। ইশারায় বা সংক্ষেপে বলিলে তাহাতে তৃপ্তি আসে না। হে বিজ্ঞ! পরে বলার আশা রাখিও না। যাহা বলার এখনই বিস্তারিত বর্ণনা কর।
বাজে গো আছরারো রমজে মুজছালীন,
আশকারা বেহ কে পেনহা ছেররে দীন।
অর্থ: ইহার পর রছুলগণের প্রেরণের রহস্য এবং উদ্দেশ্য বর্ণনা কর। কেননা, ধর্ম্মের রহস্য ও ভেদ গুপ্ত রাখার চাইতে প্রকাশ করা উত্তম।
ভাব: আল্লাহতায়ালা কর্তৃক যুগে যুগে নবী বা রছুল প্রেরণের উদ্দেশ্য ছিল ইহাই যে, তাঁহার প্রিয় বান্দাগণ ইহ-জগতের মহব্বতে আল্লাহর মহব্বত ভুলিয়া না যায়। ভ্রান্ত ব্যক্তিদিগকে আল্লাহর প্রেমের আলো দান করিয়া ইশকের আকর্ষণে আল্লাহর প্রতি অনুরাগী থাকিবে। আল্লাহ ছাড়া অন্য কাহাকেও মা’বুদ বলিয়া মানিবে না। সর্বগুণী ও সর্বশক্তিমান অদ্বিতীয় আল্লাহতায়ালা-ই উপাসনা পাইবার উপযোগী।
পরদাহ বরদার ও বরহেনা গো কে মান,
মী নাকোছ পেম বা আছনামে বা পিরহান।
অর্থ: যদি কোনো ব্যক্তি পিরহান পরিধান করিয়া মূর্তির সহিত ঘুমায়, তবে ঐ ব্যক্তি এবং মূর্তির মধ্যে একটি পর্দার পার্থক্য থাকে। ঐ রকমভাবে মূল ঘটনা এবং উদাহরণগুলি ঢাকা থাকিলে প্রকৃত রহস্য বুঝা যায় না। তাই, ইশকের মূল রহস্য পরিষ্কার করিয়া বর্ণনা করা আবশ্যক।
গোফতাম আজ উরইয়ান শওরাদ উ দর জাহান,
নায়ে তু মানি নায়ে কিনারাত নায়ে মিঞা।
অর্থ: যদি ইশকের ভেদ এই দুনিয়ায় প্রকাশ পায়, তবে সমস্ত জাহান ধ্বংস হইয়া যাইবে।
আরজু মীখাহ লেকে আন্দাজা খাহ,
বর নাতাবাদ কোহেরা এক বরগেকাহ।
তানা গরদাদ খুনে দেল জানে জাহাঁ,
লবে বা বন্দ ও দিদাহ বরদোজাইঁ জমান।
অর্থ: মাওলানা বলেন, হে মানুষ! তুমি যদি চাও তবে তোমার শক্তি অনুযায়ী চাও। কেননা, একটি বাঁশের পাতার উপর একটা পাহাড়ের ওজন সহ্য হয় না। তাই তোমার যদি চাইতে হয়, তবে তোমার শক্তি মোওয়াফিক তলব কর। নতুবা, সমস্ত জাহান ছারখার হইয়া যাইবে। অতএব, এখন তুমি চুপ করিয়া থাক।
আফতাবে কাজওয়ায়েইঁ আলম ফরুখত,
আন্দেকে গার বেশে তাবাদ জুমলা ছুখত।
ফেতনা ও আশুব ও খুঁনরিজি মজু,
বেশে আজইঁ আজ শামছে তিবরিজি মগো।
অর্থ: সূর্য, যাহা দ্বারা এই পৃথিবী আলোকিত হয়, তাহা যদি আরও কিছু নিকটে আসিয়া যায়, তবে সমস্ত জাহান পুড়িয়া ছারখার হইয়া যায়। যখন প্রকাশ্য সূর্যের প্রখরতা পৃথিবী সহ্য করিতে পারে না, তখন কেমন করিয়া হাকিকী সূর্য অর্থাৎ আল্লাহর ইশকের প্রখরতা কেমন করিয়া বরদাস্ত করিবে। এইজন্য ইশকের পূর্ণ রহস্যের কাহিনী ইহ-জগতে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। ইহার স্বাদ যে ব্যক্তি গ্রহণ করিয়াছেন, তিনি-ই নিজে নিজে স্বাদের মর্যাদা অনুভব করিতেছেন।
ইঁ নাদারাদ আখের আজ আগাজ গো,
রদ্দেতামামে ইঁ হেকাইয়েত বাজ গো।
অর্থ: এই ইশকের রহস্যের বর্ণনা আরম্ভ করিয়া ইহার শেষ নাই। অর্থাৎ, প্রেমের রহস্যের ঘটনা বর্ণনা করিয়া শেষ করা যায় না। ইহার বর্ণনা পুনরাবৃত্তি ব্যতীত গতি নাই। তাই এখন শেষ করাই কর্তব্য।
আগন্তুক অলি দাসীকে নিয়া বদশাহর নিকট হইতে একাকী হইবার প্রস্তাব এবং দাসীর রোগ ও যন্ত্রণা সম্বন্ধে তদারক করা
চুঁ হেকিম আজ ইঁ হাদীছে আগাহ শোদ,
ওয়াজ দরুণে হাম দাস্তানে শাহ শোদ।
গোফতে আয়শাহ খেলওয়াতি কুন খানা রা,
দূর কুন হাম খেশও হাম বেগানাহ রা।
কাছ নাদারাদ গোশে দর দহলিজেহা,
তা বা পুরছাম জিইঁ কানিজাক চীজেহা।
অর্থ: যখন আগন্তুক হেকিম সাহেব উক্ত দাসীর ঘটনাসমূহ জানিতে পারিলেন এবং বাদশাহর অভ্যন্তরীণ অবস্থা বুঝিতে পারিলেন, তখন হেকিম সাহেব বাদশাহকে বলিলেন, আপনি এই ঘর হইতে আপনার আপনজন ও বেগানাদিগকে দূরে সরাইয়া দেন এবং কেহ যেন এই ঘরের প্রতি কানও রাখিতে না পারে। আমি এই দাসীর নিকট অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে চাই।
খানা খালি করদে শাহা ও শোদ বেরুঁ,
তা বখানাদ বর কানিজাকে উফেছুঁন।
খানা খানি মান্দো এক দিয়ার নায়ে,
জুজ তবীব ও জুজ হুমাঁ বিমার।
অর্থ: বাদশাহ তখন তখন-ই সকলকে ঘর হইতে বাহির করিয়া দিলেন এবং নিজেও ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন। ঘরে হেকিম সাহেব এবং উক্ত রোগী ছাড়া আর কেহই রহিল না।
নরমে নরমক গোফতে শহরে তু কুজাস্ত,
কে ইলাজো রঞ্জেহর জুদাস্ত।
ও আন্দার আঁ শহর আজ কারাবাত কীস্তাত,
খুশী ও পেওয়েস্তেগী বা চিস্তাত।
দস্তে বর নবজাশ নেহাদ ও এক বএক,
বাজ মী পুরছীদ আজ জওরে ফালাক।
অর্থ: হেকিম সাহেব স্নেহ ভরে নরম নরম সুরে দাসীকে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন, তোমার দেশ কোথায়? কেননা, প্রত্যেক দেশের রোগ এবং চিকিৎসা পৃথক পৃথক। ঐ দেশে তোমার আত্মীয় এগানার মধ্যে কাহার কাহার সাথে মিল-ঝুল আছে। কার কার সাথে চলা ফিরা করিতে শান্তি পাইতে ও আনন্দ অনুভব করিতে। হেকিম সাহেব রোগীর কব্জা হাতের মধ্যে ধরিয়া জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন, কী কারণে তোমার এই রোগ হইল?
চুঁ কাছেরা খারেদর পায়াশ খালাদ,
পায়ে খোদরা বর ছারে জানু নেহাদ।
ওয়াজ ছারে চুজান হামী জুইয়াদ ছারাশ,
ওয়ার নাইয়াবাদ মী কুনাদ আজ লবে তয়াশ,
খারেদর পা শোদ চুঁনি দেশওয়ার ইয়াব,
খারে দর দিল চুঁ বুয়াদ দাদাহ জওয়াব
অর্থ: মাওলানা বলেন, যখন কোনো ব্যক্তির পায়ে কাঁটা ঢুকিয়া যায়, তবে পা খানা হাটুর উপর উঠাইয়া রাখে এবং সূঁচের মাথা দিয়া কাঁটার মাথা তালাশ করে। যদি কাঁটার মাথা না পায়, তবে নিজের মুখের লালা দিয়া ভিজাইয়া দেয়। যখন প্রকাশ্যে পায়ের একটি কাঁটা তালাশ করিতে এত কষ্ট করিতে হয়, তবে অন্তরে যদি কাহারও কাঁটা বিধিয়া যায়, তাহা হইলে কীরূপে উহা অনুমান করা যায় ভাবিয়া দেখা উচিত।
খারে দেলরা গার বদীদে হর খাছে,
দাস্ত কে বুদে গাম্মাঁরা বর কাছে।
অর্থ: যদি কোনো অজ্ঞান লোকে অন্তরের কাঁটা দেখিতে পাইত, তবে প্রত্যেকেই বুঝিতে পারিত এবং উহার প্রতিকার করিতে পারিত। চিন্তার কোনো কারণ থাকিত না। কিন্তু অন্তরের কাঁটা দেখা ও তাহার অবস্থা বুঝা সকলের পক্ষে সম্ভব নহে; ইহার জন্য কামেল পীরের দরকার। এইজন্য অন্তরের রোগের প্রতিকার জন্য প্রত্যেকের উচিত কামেল পীরের অন্বেষণ করা। কামেল পীর ব্যতীত কেহ অন্তরকে সুস্থ করিতে পারে না।
কাছ বজীরে দূমে খর খারে নেহাদ,
খর না দানাদ দাফে আঁ বরমী জোহাদ।
বর জোহুদ ও আঁখারে মোহকাম তর জানাদ,
আকেলে বাইয়াদ কে খারে বর, কানাদ।
খর জে বহরে দাফে খারে আজ ছুজ ও দরদ,
জুফতা মী আন্দাখত ছদ জা জখম করদ।
আঁ লাকাদ কে দাফে খারে উকানাদ,
হাজেকে বাইয়াদ কে বর মারকাজে তানাদ।
অর্থ: যদি কোনা ব্যক্তি গাধার লেজের নিচে একটা কাঁটা ঢুকাইয়া দেয়, গাধা তো ঐ কাঁটা বাহির করার পদ্ধতি জানে না। কাঁটার যন্ত্রণায় গাধা ছটফট করে এবং লাফাইতে থাকে এবং যখন লাফাইতে আরম্ভ করে, তখনই তাহার কাঁটা অধিক ঢুকিয়া মজবুত হয়। ঐ কাঁটা বাহির করার জন্য বুদ্ধিমান জ্ঞানীর দরকার। ঐ গাধা কাঁটার যন্ত্রণায় হাত পা আছাড় মারিতে থাকে এবং জায়গা ব-জায়গায় জখম হইয়া পড়ে। লাথি মারায় তাহার কাঁটা বাহির করার কোনোই উপকার হয় না। কোনো বিজ্ঞ লোকের দরকার, যে নির্দিষ্ট কাঁটার স্থান লক্ষ্য করিয়া কাঁটা বাহির করিতে পারে।
আঁ হেকীম খারেচীন উস্তাদে বুদ,
দস্তে মীজাদ জা বজায়ে আজমুদ।
জাঁ কানিজাক বর তরিকে রাস্তে বাঁ
বাজ মী পুরছিদ হালে পাছে তাঁ
বা হেকীমে উ রাজেহা মী গোফতে ফাস,
আজ মোকামে খাজেগান ও শহরে তাস।
অর্থ: উক্ত হেকিম সাহেব অন্তরের-কাঁটা বাহির করায় খুব ওস্তাদ ছিলেন। স্নায়ুর উপর এখানে সেখানে হাত রাখিয়া সবকিছু অনুমান করিলেন। ঐ দাসীকে সত্য কথা বলিতে বলিয়া ভালোবাসার সূত্রে অতীত কাহিনী সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। দাসী হেকিম সাহেবের নিকট পরিষ্কার করিয়া সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করিল। নিজের বাড়ির কথা, মনিবের অবস্থা এবং কোথায় কোথায় বিক্রয় হইয়াছে, সকল ঘটনাই খুলিয়া বলিয়া দিল।
ছুয়ে কেচ্ছা গোফতানাশ শী দাস্তে গোশ,
ছুয়ে নজো জুস্তানাশ মী দাস্তে হুশ।
তাকে নজা আজ নামে কে করদাদ জাহাঁ,
উ বুয়াদ মকছুদে জানাশ দরজাহাঁ।
অর্থ: হেকিম সাহেব তাঁহার কান দাসীর কথার প্রতি রাখিলেন এবং দাসীর কব্জার হরকতের দিকে খেয়াল দিলেন। কেননা, তিনি পরীক্ষা করিবেন যে, কাহার নামে তাহার স্নায়ুর গতি অস্বাভাবিকভাবে নড়িয়া উঠে। সেই-ই তাহার মাশুক বা মাহবুব বলিয়া বিবেচিত হইবে অর্থাৎ যাহার বিরহ বেদনায় এত অসুস্থ হইয়া পড়িয়াছে।
দোস্তানে শহরে খোদারা বর শুমারদ,
বাদে আজাঁ শহরে দিগার রা নামে বুরাদ।
গোফতে চুঁ বেরুদী শোদী আজ শহরে খেশ,
দরকুদামে শহরে বুদস্তী তু বেশ।
নামে শহরে বোরাদ ও জাঁহাম দর গোজাস্ত,
রংগে রুয়ে ও নজে-উ-দিগার না গাস্ত।
খাজে গাঁনো শহরেহা রা এক বএক,
বাজে গোফত আজ জায়ে ও নানো নেমক।
শহ্রে শহ্র ও খানা খানা কেচ্ছা করদ,
নায়ে রগাশ জাম্বীদ ও নায়ে রুখে গাস্ত জরদ্।
অর্থ: হেকিম সাহেব উক্ত দাসী দ্বারা তাহার নিজ দেশ ও জানাশুনা আত্মীয়-স্বজনের সম্বন্ধে পরিচয় নিলেন। তারপর অন্য এক দেশের কথা উল্লেখ করিলেন। হেকিম সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি যখন নিজ দেশ ছাড়িয়া অন্য দেশে গেলে, তখন কোন্ দেশে বেশি দিন থাকিলে? তারপর উক্ত দাসী এক শহরের নাম উল্লেখ করিল। তারপর আর এক শহরের নাম করিল। কিন্তু তাহাতে চেহারার কোনো পরিবর্তন হইল না এবং স্নায়ুর গতিবিধির কোনো পার্থক্য পাওয়া গেল না। তারপর এক এক করিয়া সকল মুনিবের অবস্থা, সকল দেশের ও জায়গার কাহিনী এবং খাদ্য খাদকের পার্থক্য বর্ণনা করিল। দেশ দেশান্তরের কাহিনী ও প্রত্যেক ঘরের অবস্থা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বয়ান করিল। কিন্তু, তাহার স্নায়ুর গতিবিধির কোনো পরিবর্তন অনুভব করা গেল না বা চেহারার রংগের কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না।
নব্জে উ বরহালে খোদ বদ বে গোজান্দ,
তা বা পুরছীদ আজ ছামারকান্দে চু কান্দ।
নব্জে জুস্ত ওরুয়ে ছোরখাশ জরদ শোদ,
কাজ ছামারকান্দিয়ে জরগার ফেরুশোদ।
উ ছরদে বর কাশীদ আঁ মা হারওয়ে,
আব আজ চশমাশ রওয়াঁশোদ হামচু জুয়ে।
গোফ্তে বাজারে গানাম আঁজা আওয়ারীদ,
খাজা জরগার দর আঁ শহ্রাম খরীদ।
দরবরে খোদ দাস্ত ছে মাহ ও ফরুখত্,
চুঁ বগোফ্ত ইঁ জানাশ গম বর ফরুখত্।
অর্থ: উক্ত দাসী বর্ণনা করিতে করিতে যখন সামারকান্দ দেশের কথা উল্লেখ করিতে লাগিল, তখনই তাহার স্নায়ুর গতি বৃদ্ধি পাইলো এবং চেহারার রং লাল-হলুদে মিশ্রিত হইয়া গেল। কেননা, ঐ সামারকান্দে একজন স্বর্ণকার তাহার মনিব ছিল। সে তাহাকে বিক্রয় করিয়া ফেলিয়াছে এবং তাহার সাক্ষাৎ হইতে দূরে রহিয়াছে। ইহা বলিয়া সে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করিল এবং চক্ষুদ্বয় হইতে নদীর স্রোতের ন্যায় অশ্রু প্রবাহিত হইতে লাগিল। সে আরও বলিতে লাগিল, কোনো এক সওদাগার আমাকে আনিয়া ঐখানে এক স্বর্ণকারের নিকট বিক্রয় করিয়াছিল। স্বর্ণকার আমাকে খরিদ করিয়া রাখিয়াছিল। তিন মাস পর্যন্ত আমাকে তাহার নিকট রাখিয়াছিল। তাহার পর আমাকে বিক্রয় করিয়া ফেলিল। ইহা বলিয়া দাসী বিরহ যন্ত্রণার অগ্নিতে প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল।
চুঁজে রঞ্জুর আঁ হেকীম ইঁ রাজে ইয়াফ্ত,
আছ্লে আঁ দরদে ও বালা রা বাজে ইয়াফ্ত।
গোফ্তে কোয়ে উ কুদামাস্ত ও গোজার,
উ ছারপল গোফ্ত ও কোয়ে গাতফার।
অর্থ: যখন হেকীম সাহেব রোগীর এই রহস্য জানিতে পারিলেন এবং ঐ প্রকৃত মূল অবস্থা বার বার অনুভব করিতে লাগিলেন, তখন হেকীম সাহেব দাসীর নিকট জিজ্ঞাসা করিলেন, ঐ স্বর্ণকারের বাড়ী কোন্ পথে ও কোন্ মহল্লায়? দাসী বলিল, ছেরপলের পথে গাতফার মহল্লায় তাহার বাড়ী।
গোফ্তে আঁগাহ আঁ হেকীমে বা ছওয়াব,
আঁ কানিজাক রা কে রাস্তি আজ আজাব।
চুঁকে দানাস্তেম কে রঞ্জাত চিস্ত জুদ,
দর ইলাজাতে চেহের হা খাহাম্ নামুদ।
শাদে বাশ্ ও ফারেগ ও আয়মান কে মান,
আঁ কুনাম বাতু কে বারানে বাচে মন।
মান গমে তুমী খোরাম্ তুগ্মে মখোর,
বর তু মান মুশফেক্ তরাম্ আজ ছদ পেদার।
হানো হাঁ ইঁ রাজে রা বা কাছ মগো,
গারচে আজ শাহ্ কুনাদ্ বছ জুস্তে জু।
অর্থঃ- যখন হেকীম সাহেব রোগীর অবস্থা বিস্তারিতভাবে জানিতে পারিলেন, তখন ঐ দাসীকে বলিলেন, তুমি অতি শীঘ্রই তোমার কষ্ট হইতে রেহাই পাইবে। যেহেতু আমি তোমার রোগ কী, উহা ধরিতে পারিয়াছি। অতি শীঘ্রই উহার ঔষধ করা হইবে এবং যাদুর ন্যায় ক্রিয়া প্রাপ্ত হইবে। অতএব, তুমি সন্তুষ্ট হও; নির্ভয় ও নিশ্চিন্ত থাক। আমি তোমার বিষয়ে এমন ব্যবস্থা করিব, যেমন বাগানে বৃষ্টি পতিত হইলে বাগান উপকৃত হয়, তেমনি তুমি আমার ব্যবস্থা দ্বারা উপকৃত হইবে। আমি তোমার জন্য চিন্তা করিতেছি, তুমি চিন্তা করিও না। আমি তোমার দুঃখ লাঘবের জন্য শত পিতার চাইতেও দয়াবান। কিন্তু সাবধান, সাবধান! এই রহস্যের কথা কাহারও নিকট প্রকাশ করিবে না, এমন কি স্বয়ং বাদশাহ্ শত চেষ্টা করিলেও যেন জানিতে না পারেন।
তা তাওয়াই পেশে কাছ মকশায়ে রাজ,
বরকাছে ইঁ দরমকুন জে নেহর বাজ।
চুঁকে আছরারাত নেহাঁদর দেলে বুদ,
আঁ মুরাদাত জুদেতর হাছেলে বুদ্।
গোফ্তে পয়গম্বর কে হরকে ছারে নেহোফ্ত,
জুদে গরদাদ্ বা মুরাদে খেশে জুফ্ত।
দানা চুঁ আন্দর জমিন পেন্হা শওয়াদ,
ছের্রে উ ছের্রে সবজি বোস্তান শওয়াদ।
জররো ও নোক্রাহ্ গার না বুদান্দে নেহাঁ,
পরওয়ারেশ কায়ে ইয়াফ্ তান্দি জীরে কান।
অর্থ: মাওলানা পাঠকদিগকে উপদেশ দিয়া বলিতেছেন, যতদূর সম্ভব নিজের মনের কথা কাহারও নিকট প্রকাশ করিবে না এবং কাহারও নিকট তোমার মনের ভেদ-কথা খুলিয়া দিও না। তোমার মনে যাহা আছে, মনেই থাকুক। তবে উহা অতি শীঘ্রই কাজে পরিণত হইবে। কেননা, নবী করিম (দঃ) ফরমাইয়াছেন, যে ব্যক্তি মনের কথা গুপ্ত রাখে, তাহার উদ্দেশ্য অতি সহজেই হাসিল হইয়া যায়। যেমন, হাদীছে বর্ণিত আছে, “ইসতায়েনু ফীল হাওয়ায়েজে বিল কিতমান।” অর্থাৎ, তোমার মনোবাসনা পূর্ণ হওয়ার জন্য আল্লাহর নিকট চুপে চুপে সাহায্য প্রার্থনা কর। মওলানা আরও দুইটি বাহ্যিক দৃষ্টান্ত দিয়া বুঝাইয়া দিতেছেন, যেমন-শস্যের দানা যখন জমিনে ঢাকিয়া রাখা হয়, তখন দানা লুকাইয়া রাখার কারণে ঐ বাগান সুফলা শস্যে শ্যামলা ও মনোরম দৃশ্য ধারণ করে। এই রকমভাবে স্বর্ণ-রৌপ্য যদি মাটির নিচে না হইত, তবে খনিতে থাকিয়া কীরূপভাবে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইত? ইহা দ্বারা বুঝা যায় যে, সফলতা অর্জন করিতে হইলে গুপ্তভাবে চেষ্টা করিতে হয়; না হইলে কিছুতেই সফলতা অর্জন করা সম্ভব নহে।
ওয়াদাহাও লুৎফেহায়ে আঁ হেকীম,
করদ্ আঁ রঞ্জুরে রা আয়মন জেবীম।
অর্থ: হেকীম সাহেবের ওয়াদা এবং স্নেহপূর্ণ কথাবার্তায় রোগীর ভয় ও ভাবনা দূর হইয়া গেল।
ওয়াদাহা বাশদ্ হাকীকি দেল পেজীর,
ওয়াদাহা বাশদ্ মাজাজী তাছাগীর।
ওয়াদায়ে আহ্লে করম্ গঞ্জে রওয়ান,
ওয়াদায়ে না আহালে শোদ রঞ্জে রওয়ান।
ওয়াদাহা বাইয়েদ ওফা করদান তামাম,
ওয়ার না খাহি করদে বাশী ছরদো খাম।
অর্থ: মাওলানা ওয়াদার কথা বলিতেছেন, খাঁটি সত্য ওয়াদা লোকের প্রাণে লাগে। আর মিথ্যা ওয়াদায় লোকের মনে সন্দেহ উদয় হয়। সত্য ও ন্যায়বান লোকের ওয়াদায় লোকের সান্ত্বনা আসে এবং উপকার হয়। আর মিথ্যুকের ওয়াদায় লোকের কষ্ট হয়। অতএব, ওয়াদা করিলে পূর্ণভাবে আদায় করিবার চেষ্টা করিবে। যদি তুমি উহা না কর, তবে তুমি মিথ্যুক বলিয়া পরিগণিত হইবে এবং অপমানিত হইবে।
উক্ত ওলী দাসীর রোগ সম্বন্ধে অবগত হওয়া এবং রোগের কথা বাদশাহর সম্মুখে পেশ করা
আঁ হেকীমে মেহেরবান চুঁ রাজে ইয়াফ্ত,
ছুরাতে রঞ্জে কানিজাক বাজ ইয়াফ্ত।
বাদে আজাঁ বরখাস্ত আজমে শাহ্ করদ,
শাহ্রা জাঁ শাম্মায়ে আগহ্ করদ্।
অর্থ: যখন উক্ত হেকীম সাহেব রোগীর প্রকৃত অবস্থা অবগত হইলেন এবং রোগের অবস্থা বুঝিতে পারিলেন, তারপর ওখান হইতে উঠিয়া বাদশাহর নিকট গেলেন এবং বাদশাহকে কোনো রকমে রোগের অবস্থা সম্বন্ধে জানাইলেন।
শাহে গোফ্ত আক্নু বগো তদ্বীরে চিস্ত,
দর চুনিইঁ গম মুজেবে তাখিরে চিস্ত।
গোফ্তে তদ্বীরে আঁ বুদ কানে মরদেরা,
হাজের আরেম্ আজ পায়ে ইঁ দরদেরা।
মরদে জরগার রা বখাঁ জা আঁ শহ্রে দূর,
বাজ রু খেলায়াত বদেহ্ উরা গরুর।
কাছেদে বফেরেস্ত কা আখবারাশ কুনাদ,
তালেরে ইঁ ফজল ও ইছারাশ কুনাদ্।
তা শওয়াদ্ মাহ্বুবে তু খোশদেল বদু,
গরদাদ আছান ইঁ হামামুশ্কিল বদু।
চুঁ বা বীনাদ ছীমো জর আঁ বে তাওয়াঁ,
বহ্রে জর গরদাদ্ জেখানে ও মানে জুদা।
অর্থ: বাদশাহ্ রোগের কথা শুনিয়া বলিলেন, ইহার তদবীর কী, আমাকে বাতলাইয়া দেন। কেননা, এই প্রকার যাতনায় কোনো রকম বিলম্ব করার সম্ভাবনা নাই। হেকীম সাহেব উত্তর করিলেন, ইহার তদবীর শুধু এই যে, ঐ স্বর্ণকারকে এই রোগ হইতে মুক্ত করার জন্য হাযীর করা একান্ত দরকার। আপনি ঐ স্বর্ণকারকে সেই দেশ হইতে ডাকিয়া পাঠান। এবং তাহাকে মণি-মুক্তা ও স্বর্ণ ও রৌপ্য উপঢৌকন হিসাবে দান করিবেন বলিয়া প্রলোভন দেখাইয়া দূত পাঠাইয়া দেন। সে যেন স্বর্ণকারকে বলে যে বাদশাহ্ সমস্ত স্বর্ণকারদের মধ্যে তোমাকেই খুব পছন্দ করিয়াছেন এবং তোমাকে পুরষ্কৃত করার জন্য তাঁহার দরবারে তলব করিয়া পাঠাইয়াছেন। পুরস্কারের প্রলোভনে গরীব বেচারা আপনার দরবারে হাযীর হইবে। তাহা হইলে আপনার প্রিয়া তাহাকে দেখিয়া মনে আনন্দ পাইবে এবং সন্তুষ্ট হইবে। তাহার সহিত মিল-মিশ করিলে অতি সহজেই রোগ মুক্ত হইবে। চেহারা আকৃতি অতি মনোরম হইবে। যত প্রকার আপদ ও বিপদ আছে সবই দূর হইয়া যাইবে। যখন ঐ গরীব স্বর্ণকার এই স্বর্ণ, রৌপ্য ও মনি-মুক্তা দেখিবে, ইহার লোভে বাড়ী-ঘর ও মান-ইজ্জত ত্যাগ করিয়া চলিয়া আসিবে।
জর খেরাদরা ওয়ালাহ্ ওশায়েদা কুনদ।
খচ্ছা মোফ্লেছরা কে খোশ রেছওয়াকুনাদ।
জর আগার চে আকল মী আরাদ্ ওয়ালেকে,
মরদে আকেল বাইয়াদ্ উরা নেক নেক।
অর্থ: মাওলানা বলেন, স্বর্ণ মানুষকে পাগল করিয়া অপমানিত করে। বিশেষ করিয়া গরীবেরা খুব তাড়াতাড়ি লালসার জালে আবদ্ধ হইয়া লজ্জিত ও অপমানিত হয়। যদিও ধন-সম্পদ লোকের জ্ঞান বাড়াইয়া তোলে; কিন্তু সকলের জ্ঞান বাড়ে না। মাল দ্বারা জ্ঞান বাড়াইবার জন্য বিচক্ষণ জ্ঞানীর দরকার। কেননা, উহা সৎকাজে ব্যয় করা দরকার, যাহাতে দীন ও দুনিয়ার উপকার হয়। এজন্য চাই ধার্মিক ও সৎসাহসী হওয়া।
চুঁকে সুরতান আজ হেকিমে আঁরা শনীদ,
পন্দে উরা আজ দেলও জান বরগুজীদ্।
গোফ্তে ফরমানে তোরা ফরমানে কুনাম,
হরচে গুই আঁ চুঁনা কুন আঁ কুনাম।
অর্থ: যখন বাদশাহ্ হেকিম সাহেবের নিকট এই পরামর্শ শুনিলেন, তখনই তাঁহার উপদেশ মানিয়া লইলেন এবং বলিলেন, আপনার নির্দেশকেই আসল নির্দেশ বলিয়া মনে করিয়া লইব এবং যাহা কিছু করিতে আদেশ করিবেন, উহাই করিব।
বাদশাহ্ স্বর্ণকারকে আনিবার জন্য বিচক্ষণ, জ্ঞানী ও সুচতুর দুইজন দূত সামারকান্দে পাঠাইলেন
পাছে ফেরেস্তাদ আঁ তরফ এক দো রাছুল,
হাজেকানে ও কাফিয়ানে ও বছ আদুল।
তা ছামারকান্দ আমদান্দ আঁ দো আমীর,
পেশে আঁ জরগার জেশাহানশাহ্ বসির।
বা আয়ে লতিফে উস্তাদ কামেলে মারেফাত,
ফাশ আন্দর শহরে হা আজ তু ছেফাত।
তক্ ফালানে শাহ্ আজ বরায়ে জরগিরী,
ইখ্তিয়ারাত করদ জিরা মেহ্তরী।
ইঁ নাকইঁ খেলায়াত বগীর ও জর ও ছীম,
চু বইয়াই খাছে বাশী ও নাদীম।
অর্থ: বাদশাহ্ স্বর্ণকারকে আনিবার জন্য বিচক্ষণ, জ্ঞানী ও সুচতুর দেখিয়া দুইজন দূত সামারকান্দে পাঠাইলেন। তাহারা উভয়েই উক্ত কাজের জন্য যথেষ্ট উপযুক্ত ছিলেন। এই দুইজনেই বাদশাহর নিকট হইতে শুভ সংবাদ লইয়া স্বর্ণকারের সম্মুখে উপস্থিত হইলেন এবং বলিলেন, হে স্বর্ণকার! তুমি অত্যন্ত সুচারুরূপে মনোহর স্বর্ণালঙ্কার তৈয়ার করিতে পার। তুমি তোমার কারিগরীতে অদ্বিতীয় বলিয়া প্রমাণিত হইয়াছ। তোমার সুখ্যাতি সমস্ত দেশে ছড়াইয়া পড়িয়াছে। তাই অমুক বাদশাহ কিছু স্বর্ণ অলঙ্কার তৈয়ার করার জন্য তোমাকে পছন্দ করিয়াছেন। কেননা, তুমি একাই এই স্বর্ণ শিল্পে প্রসিদ্ধ ব্যক্তি। এই লও তোমার পুরস্কার, উপঢৌকন ও মালমাত্তা। যখন তুমি বাদশাহ্র নিকট পৌছিবে, তখন তুমি বাদশাহ্র দরবারে বিশেষ বন্ধু বলিয়া পরিগণিত হইবে।
মরদো মালো খেলায়াত বেছইয়ারে দীদ,
গোর্রাহ শোদ আজ শহ্রো ফরজন্দাঁ বুরীদ্।
আন্দার আমদ শাদে মানে দর রাহে মরদ,
বেজুজ কানে শাহ্ কছ্দে জানাশ করদ।
আছপে তাজী বর নেশাস্ত ও শাদে তাখ্ত।
খুন বহায়ে খেশরা খেলায়াত শেনাখ্ত।
আয় শোদাহ্ আন্দর ছফ্রেহা ছাদ রেজা,
খোদ বা পায়ে খেশ্ তা ছাওয়ায়েল কাজা।
দর খেয়ালাশ মুলকো এজ্জো মেহতরী,
গোফ্তে আজরাইল রও আরে বরী।
অর্থ: স্বর্ণকার যখন অনেক ধন-সম্পদ ও মালমাত্তা দেখিল, তখন মালের জন্য পাগল হইয়া গেল। স্ত্রী, পুত্র হইতে বিদায় হইয়া আনন্দে আটখানা হইয়া চলিতে লাগিল। কিন্তু সে বুঝিতে পারে নাই যে, বাদশাহ্ তাহাকে হত্যা করিবে। ঘোড়ার উপর সওয়ার হইয়া আনন্দে চলিতে লাগিল। ঘোড়াটিকে উপহারস্বরূপ মনে করিয়াছিল। ঐ ঘোড়াই তাহার জানের বিনিময় ছিল। মাওলানা বলেন, ঐ ব্যক্তির ভ্রমণে মনের আনন্দে নিজের পায়ে হাটিয়া দুর্ভাগ্য মৃত্যুর দিকে চলিয়া যাইতেছে। তাহার মনে রাজত্ব, সম্মান ও নেতৃত্বের খেয়াল পরিপূর্ণ ছিল এবং আজরাইল নিজের ভাষায় বিদ্রুপ সহকারে বলিয়াছিলেন, চলো, নিশ্চয় তুমি রাজত্ব ও সম্মান পাইবে।
চুঁ রছিদ আজ রাহে আঁ মরদে গরীব,
আন্দার আওরদাশ বা পেশে শাহ্ তবীব।
ছুয়ে শাহানশাহ্ বোরদাশ খোশ বনাজ,
তা বছুজাদ বরছারে শামায়া তরাজ।
শাহ্দীদ উরা ও বছ তাজীম করদ্,
মাখজানে জর্রা বদু তাছলিমে কর্দ।
পাছ ফরমুদাশ কে বর ছাজাদ জে জর।
আজ ছেওয়ার ও তাওকে ও খলখাল ও কোমর।
হাম জে আনওয়ায়ে আওয়ানি বে আদাদ,
কানে চুনানে দর বজমে শাহেনশাহ্ ছাজাদ।
জর গেরেফ্ত আঁ মরদ ও শোদ মশগুলেকার,
বে খবর আজ হালতে আঁ কারেজার।
অর্থ: যখন স্বর্ণকার অনেক পথ অতিক্রম করিয়া আসিয়া পৌঁছিল, তখনই তবীব সাহেব তাহাকে বাদশাহ্র সম্মুখে নিয়া হাজির করিলেন। তবীব সাহেব অতি সন্তুষ্ট চিত্তে স্বর্ণকারকে লইয়া বাদশাহর নিকট গেলেন। এইজন্য যে, স্বর্ণকারকে দাসীর জন্য জ্বালাইয়া দিতে পারিবে। বাদশাহ্ তাহাকে দেখিবা মাত্র সম্মানিত করিলেন ও স্বর্ণের স্তুপ তাহার সম্মুখে হাজির করিয়া দিয়া বলিলেন, ইহা দ্বারা তুমি কঙ্কণ, হার, বালা ও পেয়ালা ইত্যাদি তৈয়ার করিবে, যাহা বাদশাহর দরবারে শোভা পায়। স্বর্ণকার স্বর্ণ নিয়া কাজে লাগিয়া গেল। কিন্তু প্রকৃত রহস্যের কথা বুঝিতে পারিল না।
পাছ হেকীমাশ গোফ্তে কায়ে ছুলতান মেহ,
আঁ কানিজাক রা বদী খাজা বদেহ্।
তা কানিজাক দর বেছালাশ খোশ শোদ,
আব বেছালাশ দাফেয় আঁ আতেশ শাওয়াদ।
অর্থ: তারপর হেকীম সাহেব বাদশাহ্কে বলিলেন, দাসীকে বিবাহ-সূত্রে স্বর্ণকারের কাছে দিয়া দেন। তাহা হইলে স্বর্ণকারের সহিত তাহার মিলনে বিরহ জ্বালা দূর হইয়া যাইবে।
শাহ্ বদু বখশীদ আঁ মাহ রুয়েরা,
জুফতে করদ আঁ হরদো ছোহবাত জুরেরা।
মুদ্দাত শশ্ মাহে মী রান্দান্দে কাম,
তাব ছোহবাত আমদ আঁ দোখতার তামাম।
অর্থ: বাদশাহ ঐ দাসীকে বিবাহসূত্রে স্বর্ণকারকে দিয়া দিলেন। এখন উভয়েই মিলন-বাসনার সুযোগ পাইল। আতএব, উভয়েই একে অন্যের থেকে ছয় মাস পর্যন্ত বাঞ্ছিত মিলনের ফল ভোগ করিল এবং দাসী সম্পূর্ণ সুস্থ হইয়া গেল।
“মাহবুবের মিলনে শরীর সুস্থ হওয়াটা ডাক্তারী বিধান।”
বাদে আজ আঁ আজ বহরে উ শরবতে বছাখত,
তা বখোরদ ও পেশে দখতর মী গোদাখত,
চুঁ জর ব খোরিয়ে জামাল উ নামানাদ,
জানে দোখতার দরু বালে উ না মানাদ।
চুঁকে জেশত ও নাখোশ ও রোখে জর শোদ,
আন্দেক আন্দেক আজ দেলে উ ছরদ শোদ।
অর্থ: ইহার পর বিজ্ঞ হেকীম সাহেব স্বর্ণকারকে পান করাইবার জন্য এক প্রকার শরবত তৈয়ার করিলেন। স্বর্ণকার ঐ শরবত পান করিত এবং দাসীর নিকট আসা-যাওয়া করিত। শরবত পান করার দরুন স্বর্ণকারের চেহারার রং ক্রমান্বয়ে খারাপ হইতে লাগিল। যখন স্বর্ণকারের চেহারা সম্পূর্ণভাবে কুশ্রী হইয়া পড়িল – পূর্বের সেই সৌন্দর্য্য আর বাকী নাই, তখন দাসীর মন আস্তে আস্তে স্বর্ণকার হইতে দূরে সরিয়া পড়িল এবং স্বর্ণকারকে খারাপ দৃষ্টিতে দেখিতে আরম্ভ করিল। অন্তর হইতে স্বর্ণকারের ভালোবাসা ভুলিয়া গেল।
ইশকে হায়ে কাজ পায়ে রংগে বুদ,
ইশকে নাবুদ আকে বাত নাংগে বুদ।
অর্থ: মাওলানা বলেন, উপরের ঘটনা দ্বারা দেখা যায় যে স্বর্ণকারের রূপ-লাবণ্য লোপ পাওয়ার দরুন দাসীর ভালোবাসাও লোপ হইয়া গেল। ইহাতে বুঝা যায় যে, প্রেম ও ভালোবাসা শুধু রূপ-লাবণ্য দেখিয়া মোহে আবদ্ধ হয়, উহা প্রকৃতপক্ষে ইশ্ক বা প্রেম নয়। উহার শেষ ফল লজ্জিত ও নিরাশ হওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। অর্থাৎ, ইশ্কের ফলাফল যাহা প্রাপ্য, এ প্রকার ইশ্ক দ্বারা তাহা হাসিল করা যায় না, বরং উহার শেষফল দুঃখময় ও লজ্জাপূর্ণ। যখন ঐরূপ প্রেমের প্রকৃত অবস্থা প্রকাশ পায়, তখন আফসোস করে যে, আমি কী প্রকার পশুত্বের মধ্যে লিপ্ত ছিলাম।
ভাব: এখানে উপরোল্লিখিত ঘটনা দ্বারা বুঝা যায় যে ইশ্কে মাজাজী নিন্দনীয়। কারণ, উহার শেষফল হতাশা ও নিরাশা ব্যতীত কিছুই নয়। কিন্তু ইশ্কে মাজাজী ছাড়া ইশ্কে হাকিকী পয়দা হয়না। ইহা একটি স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম।
প্রকাশ থাকে যে, ইশ্কে মাজাজী করিতে হইলে কয়েকটি নিয়মের অধীন থাকা দরকার; তাহা না হইলে ইশ্কে হাকিকী পয়দা হইবে না। যেমন, অন্যস্থানে ইহার শর্তাবলী বর্ণনা করা হইয়াছে।
ফাশ কানে হাম নাংগে বুদে ইয়াক্ছীর,
তা না রফ্তে বর ওয়ায়ে আঁ বদ দাওয়ারী।
অর্থ: মাওলানা বলেন, ইশ্কে মাজাজীর মধ্যে যদি শর্তসমূহ পালিত না হয়, তবে উহার পরিণতি একদম শোচনীয়। তদোপরি, যদি ইশ্কে মাজাজীর ব্যাপারে অপক্ক হয়, অথবা শীঘ্রই লোপ পায়, তবে তাহার অবস্থা আরো শোচনীয়রূপ পরিগ্রহ করে। যেমন, উল্লেখিত দাসী ও স্বর্ণকারের অবস্থা।
চুঁ দাওবিদ আজ চশমে হাম চুঁ জুয়ে উ,
দুশমনে জানে ওয়ায়ে আমদ রুয়ে উ।
দুশমনে তাউছ আমদ পররে উ,
আয়ে বছা শাহরা বকোশতা কররে উ।
অর্থ: মাওলানা বলেন, স্বর্ণকারের সৌন্দর্য তাহার জানের দুষমন ছিল। অর্থাৎ, সৌন্দর্যের কারণে এখন তাহাকে মৃত্যু বরণ করিতে হয়। তাই সে নিজের মৃত্যুর কথা মনে করিয়া দুঃখে তাহার চক্ষু হইতে নদীর স্রোতের ন্যায় অশ্রু বহিতেছে। যেমন, ময়ূর পাখীর প্রাণ বধের কারণ সুন্দর পাখা। সুন্দর পাখা না থকিলে তাহাকে কেহ শিকার করিত না। এ রকম অনেক বাদশাহ্ আছেন, যাহাদের নিহত হওয়ার কারণ তাহাদের শান-শওকাত ও দব্দবা। যদি তাহাদের শান-শওকাতের সুখ্যাতি না থাকিত, তবে তাহদের ভয় কাহারও অন্তরে থাকিত না এবং হত্যাও করিত না।
চুঁকে জরগার আজ মরজে বদ হালে শোদ,
ওয়াজ গোদাজাশ শখ্ছে উচুঁ নালে শোদ।
গোফতে মান আঁ আহুয়াম কাজ নাফে মান,
রীখত ইঁ ছাইয়াদ খুনে ছাফে মাঁন।
আয় মানে রু বাহ্ ছেহরা কাজ কমীন,
ছার বুরি দান্দাম বরায়ে পুস্তীন।
আয়ে মান আঁ পীলে কে জখমে পীলবান,
রীখতে খুনাম আজ বরায়ে উস্তোখান।
আঁকে কোশাছতাম পায়ে মা দুনেমান,
মী নাদানাদ কে নাখোছ পাদ খুনে মান।
বরনীস্ত এমরোজ ফরদা বর ওয়ায়েস্ত।
অর্থ: যখন স্বর্ণকার রোগে আক্রান্ত হইয়া খারাপ চেহারার হইয়া গেল এবং শরীর জীর্ণশীর্ণ হইয়া কলমের নিবের মত হইয়া গেল, তখন বলিতে লাগিল, আমার অবস্থা ঐ হরিণের ন্যায়, যাহার নাভীস্থল হইতে শিকারী সমস্ত রক্ত বাহির করিয়া নিয়াছে। অথবা ঐ হাতীর ন্যায়, যাহার হাড় নিবার জন্য হাতীর রক্ষক জখম করিয়া চলিয়াছে। যে ব্যক্তি আমাকে আমার চাইতে হীনতর মুনাফার জন্য হত্যা করিয়া চলিয়াছে; অর্থাৎ, হেকিম সাহেব আমাকে বাদশাহ্র উপকারের জন্য হত্যা করিতেছে। যে আনুপাতিকভাবে আমার চাইতে কম মরতবা রাখে। সে জানেনা যে আমার রক্ত বৃথা যাইবে না। আজ আমার ধ্বংস, কাল আমার হত্যাকারীর ধ্বংস অনিবার্য। আমার ন্যায় মানুষের রক্ত কখনও বৃথা যাইতে পারে না।
গারচে দেউয়ারে আাফগানাদ ছায়া দরাজ,
বাজে গরদাদ ছুয়ে উ আঁ ছায়া বাজ।
ইঁ জাহন কোহাস্ত ও ফেলে মান্দা,
ছুয়ে মা আইয়াদ নেদাহারা ছদা।
অর্থ: মাওলানা বলেন, ইহ-জগতের কর্মফল দেওয়ালের ছায়ার ন্যায়, প্রথমে ছায়া লম্বাভাবে পতিত হয়, তারপর আস্তে আস্তে ফিরিয়া আসিয়া নিজের উপর পতিত হয়। এই বিশ্বটা একটা পাহাড়ের ন্যায় এবং আমাদের কর্ম প্রতিধ্বনির ন্যায়। আওয়াজ দিবার পর নিশ্চয়ই প্রতিধ্বনি সৃষ্টি হয়। ঐ রকমভাবে আমাদের কর্মের ফলাফল আমাদের প্রতি-ই ফিরিয়া আসে।
ইঁ বদোফ্ত ও রফ্ত দরদম জীরে খাক,
আঁ কানিজাক শোদ জে ইশ্কো রঞ্জে পাক।
জাঁ কে ইশকে মরদেগানে পায়েন্দাহ্ নিস্ত,
চুঁ মুরদাহ্ ছুয়ে মা আয়েন্দাহ্ নিস্ত।
ইশ্কে জেন্দাহ দর রওয়াঁওদর বছর,
হরদমে বাশদ চুঁ গুন্চা তাজা তর।
ইশ্কে আঁ জেন্দাহ গুজী কো বাকীস্ত,
ওয়াজ শরাবে জান ফজাইয়াত ছাকীস্ত।
ইশ্কে আঁ বগুজী কে জুমলা আম্বিয়া,
ইয়াফতান্দ আজ ইশ্কে উ কারো কিয়া।
তু মগো মারা বদাঁ শাহ ইয়ারে নিস্ত,
বা করিমানে কারেহা দেশ ওয়ারে নিস্ত।
অর্থ: ঐ স্বর্ণকার তাহার বক্তব্য পেশ করিয়া মরিয়া গেল। দাসী তাহার প্রেম হইতে মুক্তি পাইল। বিরহ যাতনা দূর হইল। কেননা, মৃত লোকের প্রেম স্থায়ী নয়। যেমন, মৃত ব্যক্তি পুনঃ ফিরিয়া আসিবে না। কিন্তু, জীবিত ব্যক্তির প্রেম স্থায়ী, যেমন ‘হাইউল কাইউম’। আল্লাহ্তায়ালা চিরজীবী। তাঁহার প্রেমও চিরস্থায়ী। প্রেম রূহ্তে সর্বদা শক্তি যোগায়। অতএব, জীবিতের প্রেম করা চাই, যে সর্বদা জীবিত ও স্থায়ী। শরাব যেমন প্রাণে শান্তি ও আনন্দ দেয়, তেমনি প্রেম রূহ্কে শান্তি ও শক্তি দান করে। অতএব, ঐ চিরজীবীর ইশ্ক শিক্ষা করো, যাহার ইশ্কের দরুন সমস্ত আম্বিয়াগণ ইজ্জত ও সম্মানের অধিকারী হইয়াছেন। কিন্তু তুমি মনে করিও না যে, খোদার দরবার পর্যন্ত পৌঁছা আমার ন্যায় মানুষের কাজ নয়। কেননা, দয়ালুর নিকট কোনো কাজ-ই কঠিন নয়। তুমি যদি একাগ্র চিত্তে থাক, তবে তোমাকে তিনি দয়া করিয়া গ্রহণ করিবেন। কেননা, খোদাতায়ালা নিজেই বান্দার প্রতি দয়াপরবশ হইয়া বলিয়াছেন, আমার বান্দা যদি আমার দিকে এক বিঘত অগ্রসর হয়, তবে আমি তাহার দিকে এক হাত অগ্রসর হই। এইরূপভাবে বান্দা নিজে যতখানি অগ্রসর হইবে, আল্লাহ্তায়ালা দয়া করিয়া তাহার দিকে দ্বিগুণ-তিনগুণ বেশী অগ্রসর হইবেন।
আল্লাহর ইশারায় বিষ প্রয়োগে স্বর্ণকারের মৃত্যুর ঘটনা
কোস্তানে আঁ মরদে বর্ দস্তে হেকীম,
নায়ে পায়ে উমেদে বুদ ওনায়ে জেবীম।
ও না কুস্তান্ আজ বরায়ে তবেয় শাহ্,
তা নাইয়া মদ্ আ মরদে ইল্হাম আজ ইলাহ্।
অর্থ: ঐ স্বর্ণকারকে বিষপান করাইয়া হত্যা করা হেকীম সাহেবের কোনো স্বার্থের জন্য নহে যে, বাদশাহ্র নিকট হইতে পুরস্কার লাভ করিবে অথবা বাদশাহ্র তরফ হইতে কোনো ভীতির কারণও ছিল না এবং বাদশাহ্র সন্তুষ্টির জন্যও ছিল না। শুধু আল্লাহর ইশারায় হত্যা করা হইয়াছিল।
আঁ পেছার রা কাশে খেজরে বা বুরিদে হল্ক,
ছের্রে আঁরা দর্ নাইয়াবদ্ আমে খল্ক।
অর্থ: এই উদাহরণ, যেমন, হজরত খিজির (আঃ) এক বালককে হত্যা করিয়া ফেলিয়াছিলেন। তাহার ভেদ অনুধাবন করা সর্বসাধারণের পক্ষে সহজ নয়।
আঁকে আজ হক্কে ইয়াবদ্ আও ওহিয়ে খেতাব,
হরচে ফরমাইয়াদ্ বুদে আইনে ছওয়াব।
আঁকে জানে বখ্শাদ্ আগার বকুশাদ রওয়াস্ত।
নায়েব্যস্ত ও দাস্তে উ দাস্তে খোদস্ত।
অর্থ: এই কাজের প্রমাণ হওয়া চাই – আল্লাহর নিকট হইতে ওহি বা ইল্হাম প্রাপ্ত হওয়া। আল্লাহ্ যাহা বলিবেন তাহাই সত্য এবং সঠিক। যিনি জান দান করেন, তিনি মৃত্যুও দিতে পারেন। অর্থাৎ, আল্লাহতায়ালা রূহ্ প্রদান করিতে পারেন এবং তিনি-ই উহা কবজ করাইতে পারেন। যাহা হউক, প্রতিনিধির কাজও তাঁহার কাজ। সেই হেতু, আমাদের আপত্তি করার কোনো কারণ নাই।
হাম্চু ইস্মাইলে পেশাশ ছার রনেহ্,
শাদ্ ও খান্দাঁ পেশে তেগাশ্ জান্ বদেহ্।
তা বে মানাদ্ জানাত্ খান্দাঁ তা আবাদ্,
হাম্চু জানে পাকে আহ্মদ বা আহাদ্।
অর্থ: মাওলানা এখানে হযরত ইস্মাইল (আঃ) ও আমাদের প্রিয় নবী হজরত মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর দৃষ্টান্ত পেশ করিয়া বলিতেছেন, যেমন হজরত ইস্মাইল (আঃ) মৃত্যুর সম্মুখে নিজের গর্দান রাখিয়া দিলেন, হাসি-মুখে তরবারির নিচে নিজের জান দিয়া দিলেন। কেননা, তিনি জানিতেন যে মাহ্বুবের নৈকট্য লাভ করিতে পারিলেই চিরদিন প্রাণ শান্তিতে থাকিতে পারিবে। যেমন, হজরত মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) আহ্কামে ইলাহির উপর সন্তুষ্ট চিত্তে রাজী থাকিয়া পূর্ণভাবে আমল করিয়া খোদার সন্তুষ্টি লাভ করিয়াছেন।
আশেকানে জামে ফরাহ্ আঁগাহ্ কাশান্দ,
কে বদস্তে খেশে খুবানে শানে কুশান্দ।
অর্থ: প্রেমিকরা ঐ সময় সন্তুষ্টি লাভ করে, যে সময় মাশুক নিজের হাতে তাহাকে হত্যা করে।
ভাব: খোদার প্রেমিক ঐ সময় সান্ত্বনা পায়, যে সময় পীরে কামেল প্রিয় মুরশেদ রিয়াজাতের কঠিন পদ্ধতি বাতলাইয়া দেন এবং উহা দ্বারা কু-রিপুগুলি দমন হইয়া যায়। তখন সে স্থায়ী শান্তি লাভ করিতে থাকে। তাহাতেই সে তৃপ্তি পায়। অতএব, কামেল পীরের নির্দেশে কঠিন রিয়াজাতে অভ্যস্ত হওয়া দরকার।
শাহ্ আঁ পায়ে শাহ্ওয়াত্ না কর্দ,
তু রেহা কুন্ বদ্ গুমানে ও না বোরাদ্।
তু গুমানে করদী কে করদ্ আলুদেগী,
দর ছাফ্ গাশ্কে হেলাদ্ পালুদেগী।
বহ্র আঁ নাস্ত ইঁরিয়াজাত ওইঁ জাফা,
তা বর আরাদ্ কো রাহে আজ্ নাক্ রাহ্ জাফা।
বোগ্জার আজ্ জন্নে খাতা আয় বদ্গুমান,
ইন্নাবাজা জ্জান্নে ইসমারা বখাঁন।
বহ্রে আঁ নাস্তে ইম্তেহানে নেক্ ও বদ্
তা বজুশাদ্ বর ছারে আরাদ্ জর্রে জাবাদ্।
গার না বুদে কারাশে ইল্হামে ইলাহ্,
উ ছাগে বুদে দরান্দাহ্ না শাহ্।
পাকে বুদ্ আজ শাহ্ওয়াতে ও হেরছো ও হাওয়া,
নেকে করদ্ উ লেকে নেক্ বদ্নমা।
অর্থ: বাদশাহ্ ঐ হত্যা কু-রিপুর তাড়নায় করেন নাই। তোমরা তাঁহার প্রতি খারাপ ধারণা করিও না। তুমি হয়ত ধারণা করিবে যে বাদশাহ ঐ কাজ পাপের কাজ করিয়াছেন। কিন্তু, এই ধারণা ভুল। কেননা, বাদশাহ রিয়াজাত দ্বারা অন্তর সাফ তথা পুতঃপবিত্রতা হাসিল করিয়াছেন। আত্মিক পরিশুদ্ধির রিয়াজাতের মধ্যে কোনো খারাপ কাজের ধারণা থাকিতে পারে না। এই জন্যই রিয়াজাত ও মোজাহেদাহ্ চর্চা করা হয়। ইহা দ্বারা নেক কাজের গুণ সঞ্চয় হয়। বদ কাজের ক্ষমতা লোপ পায়। যেমন, রৌপ্যকার রূপা গলাইয়া আবর্জনা, ময়লা পরিষ্কার করে, গলানো কাজ রিয়াজাতের ন্যায় ময়লা জুদা হওয়া তাসফিয়া-স্বরূপ। অতএব, তোমাদের খারাপ ধারণা করা চাই না। কেননা, আল্লাহতায়ালা কী বলিয়াছেন, খেয়াল করা চাই। তিনি বলিয়াছেন, কোনো কোনো সন্দেহ নিশ্চয়-ই পাপ। ভাল-মন্দের পরীক্ষা এইজন্য করা হয় যে, প্রত্যেককেই পৃথকভাবে জানা যায়। যেমন, স্বর্ণ গরম পাইয়া উত্তপ্ত হইতে থাকিলে আবর্জনা ও ময়লা সমস্ত উপরে আসিয়া ভাসিতে থাকে এবং সহজেই বাহির করিয়া ফেলিয়া দেওয়া যায়। এখন দেখা যায় যে, বাদশাহ্র কাজ যদি ইল্হাম অনুযায়ী না হইত, তাহা হইলে তাহাকে স্বার্থের কুত্তা বলা হইত। বাদশাহ কী করিয়া হইত? প্রকৃতপক্ষে বাদশাহ্ লোভ-লালসা হইতে পবিত্র ছিলেন। তিনি যাহা কিছু করিয়াছেন, ভালই করিয়াছেন, কিন্তু প্রকাশ্যে খারাপ দেখায়।
গোর্ খেজের্ দর্ বহারে কেশ্তি রা শেকাস্ত,
ছদ্ দরুস্তী দর্শেকাস্তে খেজেরে হাস্ত।
ও হাম্ মূছা বা হামা নূরো ও হুনার,
শোদ্ আজ আঁ মাহ্জুব তুবে পর্ মপর্।
অর্থ: যদিও খিজির (আঃ) দরিয়ার মাঝে নৌকা ছিদ্র করিয়া দিয়াছিলেন, কিন্তু খিজিরের ছিদ্র করাই নৌকার উত্তম হেফাজাত ছিল এবং হজরত মূসা (আঃ) মারেফাত ও নবুয়তে পরিপূর্ণ জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও হজরত খিজিরের (আঃ) কাজের ভেদ বুঝিয়া উঠিতে পারেন নাই। অতএব, তোমরা পাখা ব্যতীত উড়িতে চেষ্টা করিও না।
আঁ গোলে ছুরখাস্ত তু খুনাশ মখাঁ,
মস্তে আকলাস্ত উতু মজনুনাশ মখাঁ।
অর্থ: কোনো কোনো সময় নেক-কর্ম ও বদ-কর্ম একই রকম দেখায়। যেমন, লাল গোলাপ এবং রক্ত একই রং দেখায়, কিন্তু পাক আর না-পাকির মধ্যে পার্থক্য আছে। ঐ রকম এক ব্যক্তি জ্ঞানে ও মারেফাতে পরিপূর্ণ বিধায় বে-খোদীতে মশগুল এবং অন্য ব্যক্তি পাগল, জ্ঞানহারা; উভয়কেই এক রকম দেখায়, কিন্তু উভয়ের মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান আছে। অতএব, বাহ্যিক দৃষ্টিতে এক রকম দেখাইলে উভয়কে এক রকম মনে করা ঠিক নহে।
গারবুদে খুনে মোছলমান কামে উ,
কাফেরাম গার বুরদামে মান নামে উ।
মী বলার জাদ আরশে আজ মদেহ্ শাকী,
বদগুমান গরদাদ জে মদাহাশ মোত্তাকী।
অর্থ: মাওলানা বলেন, যদি ঐ ব্যক্তির মুসলমান হত্যা করা উদ্দেশ্য হইত, তবে আমার পক্ষে তাহার নাম লওয়াও কুফরী হইত। কেননা, হাদীসে বর্ণিত হইয়াছে যে, যদি কোনো ব্যক্তি ফাসেক ব্যক্তির প্রশংসা করে, তবে আল্লাহতায়ালা রাগান্বিত হন এবং আল্লাহর আরশ কাঁপিয়া উঠে এবং ফাসেকের প্রশংসায় নেক লোক খারাপ বলিয়া প্রমাণিত হয়।
শাহবুদ ওশাহে বছ আগাহ্বুদ,
খাছ বুদ ও খাচ্ছায় আল্লাহ বুদ।
অর্থ: বাদশাহ বাদশাহ-ই ছিলেন, এবং আল্লাহর অলিও ছিলেন। আল্লাহর খাস বান্দা হিসাবে মহাপ্রভুর নিকট প্রিয় ছিলেন।
আঁ কাছেরা কাশ চুনিইঁ শাহে কোশাদ।
ছুয়ে তখতো ও বেহতরিইঁ জায়ে কাশাদ।
অর্থ: মাওলানা বলেন, হয়ত স্বর্ণকারকে হত্যা করায় স্বর্ণকারের উপকার হইয়াছে। যেমন, খিজির (আঃ) বালককে হত্যা করিয়াছিলেন, বালকের উপকারের জন্য। সেই রকম স্বর্ণকারকে তার পরকালের শান্তির জন্য হত্যা করা হইয়াছে; যাহা ইহকালের বাদশাহীর চাইতেও মঙ্গলময়।
কহর খাছে আজ বরায়ে লুৎফে আম,
শরায়ামী দারাদ রওয়া বুগজারে গাম।
অর্থ: সর্বসাধারণের উপকারের জন্য ব্যক্তিগত ক্ষতি স্বীকার করা মোহাম্মদী শরিয়াতে জায়েজ আছে। ইহাতে কাহারও আপত্তি করা উচিত না।
গার নাদীদে ছুদে উ দর কাহারে উ,
কায়ে শোদে আঁ লুৎফে মতলক্ কাহারে উ।
তেফ্লে মী লারজাদ জেনেশে ইহ্তে জাম,
মাদারে মুশফেক আজাঁ গম শাদে কাম।
নীমে জানে বোস্তানাদ ও ছদ জানে দেহাদ,
আঁচে দরু হিম্মাত নাইয়ায়েদ আঁ দেহাদ্।
তু কিয়াছ আজ শেখ মগিরি ওয়ালেকে,
দুর দুর উফতাদাহ্ বে নেগার তু নেক।
পেশতর আতা বগুইয়েম কেচ্ছা।
বুকে ইয়াবি আজ বইয়া নাম্ হেচ্ছা।
অর্থ: মাওলানা বলেন, অস্থায়ী প্রাণ চলিয়া গেলে স্থায়ী প্রাণ পাওয়া যায়। ইহাতে যাহার সাহস নাই, তাহাকেও প্রাণ দিতে হইবে। তাহা হইলে স্থায়ী জীবন লাভ করিতে পারিবে। অর্থাৎ, যদিও প্রকাশ্যে দেখা যায় যে স্বর্ণকার মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে চিরস্থায়ী জীবন লাভ করিয়াছে। এইজন্য তুমি বুজর্গ আদমীকে তোমার নিজের ন্যায় অনুমান করিও না। তুমি বোজর্গবৃন্দের মহত্ব অনুভব করা হইতে বহু দূরে অবস্থান করিতেছ। এ সম্বন্ধে আমি একটি গল্প বলিব। আশা করি এই গল্প দ্বারা উল্লিখিত ঘটনা তুমি পরিষ্কারভাবে বুঝিতে পারিবে।
একজন বাক্কলী দোকান্দার ও একটি তোতা পাথী, এবং তোতা পাখীর দোকানের তৈল ফেলিয়া দেওয়া, বাক্কলী দোকানদারের জিজ্ঞাসা করায় তোতার চুপ করিয়া থাকা
বুদ বাক্কএল মর উরা তুতী,
খুশ নাওয়া ও ছবজো গুইয়া তুতী
বর দোকানে বুদে নেগাহবানে কানে,
নক্তাহ্ গোফ্তে বা হামা ছওদা গারানে।
দর খেতাবে আদমী নাতেক বুদে,
দর নাওয়ায়ে তুতীয়াঁ হাজেক বুদে।
অর্থ: মাওলানা বলেন, এক আতর বিক্রেতার একটি তোতা পাখী ছিল। পাখীটি সুমধুর সুরে আওয়াজ দিতে পারিত। আতর বিক্রেতা তোতাকে দোকান দেখাশুনার জন্য রাখিত। ঐ তোতা মানুষের ন্যায় খরিদ্দারদের সাথে কথা-বার্তা বলিতে জানিত। পাখীটি কথা বলার দিক দিয়া মানুষের ন্যায় ছিল। এবং সুমধুর গান করিতে সক্ষম সুচতুর তোতা পাখী ছিল।
খাজা রোজে ছুয়ে খানা রফতাহ্ বুদ,
দর দোকানে তুতী নেগাহবানে নামুদ।
গোরবায়ে বরজুস্ত নাগাহ্ আজ দোকান,
বহরে মুশে তুতীক আজ বীমে জান।
জুস্তে আজ ছদরে দোকান ছুয়ে গেরীখ্ত,
শীশাহায়ে রৌগানে গোল রা বরীখ্ত।
অর্থ: একদিন মালিক তোতাকে দোকান দেখাশুনা করার জন্য রাখিয়া বাড়ী চলিয়া গেল। হঠাৎ, একটা বিড়াল একটা ইদুর শিকার করার জন্য লম্ফ দিয়া পড়িল। তোতা দোকানের মাঝখানে গদীতে বসা ছিল। বিড়ালের ভয়েতে নিজের প্রাণ রক্ষার জন্য লম্ফ দিয়া এক পার্শ্বে যাইয়া বসিল। সেখানে আতরের শিশিগুলি রাখা ছিল। তোতার পাখা ও পায়ে লাগিয়া সমস্ত শিশি পড়িয়া গেল।
আজ ছুয়ে খানা বইয়া মদ খাজাশ,
বর দোকানে বনেশাস্ত ফারেগে খাজাওশ।
দীদে পুর রৌগানে দোকান ওজামা চরব,
বর ছারাশ জাদ গাস্ত কুল জে জরব।
অর্থ: বাড়ী হইতে যখন মালিক আসিল এবং নিশ্চিন্তে দোকানে বসিল, তখন দেখিতে পাইল যে, সমস্ত দোকান এবং যে সমস্ত ফরাশ কাপড় বিছানো ছিল সবই তৈলে সিক্ত হইয়া গিয়াছে। মালিক নমুনা দেখিয়া বুঝিল যে, এই সব কাণ্ড ঐ তোতার কারণেই হইয়াছে। রাগান্বিত হইয়া তোতাকে এত পরিমাণ মারিল যে, তোতার ‘পর’ (পালক) সবই উড়িয়া গেল। অবশেষে টাক-পড়া হইয়া গেল।
রোজ কে চান্দে ছুকান কোতাহ করদ,
মরদে বাক্কাল আজ নাদামাত আহ্করদ।
রেশে বর মী কুনাদ ও গোফ্ত আয়ে দেরেগ,
কা আফ্তাবে নেয়ামাতাম শোদ জীরে মেগ।
দস্তে মান বশে কাস্তাহ বুদে আঁ জমান,
চুঁ জাদাম মান বর ছারে আঁ খোশ জবান।
হাদীয়াহা মী দাদ হর দরবেশ রা,
তা বইয়ায়েদ নূতকে মোরগে খোশেরা।
অর্থ: কয়েকদিন পর্যন্ত তোতা রাগ হইয়া কথা বলা ত্যাগ করিয়া দিয়াছে। ইহাতে আতর বিক্রেতা অত্যন্ত দুঃখিত ও লজ্জিত হইল এবং শুধু নিজের দাড়ী ও চুল অঙ্গুলি দিয়া মোচড়াইতেছিল আর আফসোস করিতেছিল, আহা! আমার দোকানের রৌনাক চলিয়া যাইতেছে। যেমন, বাদলা দিনে সূ্র্যের কিরণ ঢাকিয়া যায়, জমিনের চাকচিক্য কমিয়া যায়, সেই রকম আমার দোকানের রৌশনি চলিয়া যাইতেছে। আমি যখন ইহাকে মারিতে ছিলাম, তখন আমার হাত ভাঙ্গিয়া গেল না কেন? সে গরীব-মিসকীনকে দান-খয়রাত করিতে আরম্ভ করিল, যাহাতে তোতা পুনঃ কথা বলিতে আরম্ভ করে।
বাদে ছে রোজ ও ছে শবে হয়রান ও জার,
বর দোকানে বনেশাস্তাহ বুদ নাও উমেদ ওয়ার
বা হাজারাঁ গোচ্ছা ওগম গাস্তে জোফ্ত,
কা আয়ে আজব ইঁ মোরগেকে আইয়াদ গোফ্ত।
মী নামুদ আঁ মোরগেরা হর গোঁ শেগাফ্ত,
ওয়াজ তায়াজ্জুব লবে বদান্দান মী গেরেফ্ত।
ওয়া মী দমে মী গোফ্ত বা উ হর ছুখান,
তাকে বাশদ আন্দর আইয়াদ দর ছুখান।
বর উমেদে আঁকে মোরগে আইয়াদ বগোফ্ত,
চশমে উরা বা ছুয়ারে মী করদে জুফ্ত।
অর্থ: এইভাবে তিন দিন তিন রাত্রি অতিবাহিত হইবার পর আতর বিক্রেতা অত্যন্ত চিন্তিত ও দুঃখিত অবস্থায় নিরাশ হইয়া দোকানে বসিয়া ভাবিতেছিল যে, দেখি তোতা কোন্ সময় কথা বলে। নানা প্রকারের আশ্চর্যজনক বস্তু তাহাকে দেখাইতেছিল এবং অবাক হইয়া দাঁতে অঙ্গুলি কাটিতেছিল। তোতার সাথে নানা প্রকারের রং ঢং-এর কথাবার্তা বলিতেছিল, যাহাতে তোতা কথা বলিয়া উঠে। উহার কথা বলার আশায় সম্মুখে রং বেরংয়ের ছবি নিয়া দেখাইতেছিল। কিন্তু কিছুতেই ফল হইতেছিল না।
জও লাকিয়ে ছার বরহেনা মী গোজাস্ত,
বা ছারে বে মুচু পোস্ত তাছে ও তাস্ত।
তুতী আন্দর গোফতে আমদ দর জমান,
বাংগে বর দরবেশে জাদ কে আয়ফুলান।
আজ চে আয়ে কুল বাকেলানে আ মিখ্তি,
তু মাগার আজ শিশায়ে রৌগান রীখ্তি।
আজ কিয়াছাশ খান্দাহ্ আমদ খলকেরা,
কো চ খো পেন্দাস্তে ছাহেবে দল্কেরা।
অর্থ: তিন দিন পরে আতর বিক্রেতা নিরাশ অবস্থায় দোকানে বসিয়াছিল। এমন সময় ছেঁড়া কম্বল পরিধানকারী মাথায় টাক পড়া এক দরবেশ ঐ দোকানের সম্মুখে দিয়া যাইতেছিল। তাহার মাথা শকুনের মাথার ন্যায় পরিষ্কার ছিল। তোতা তাহাকে দেখিবামাত্র বলিয়া উঠিল; ওহে দরবেশ! তোমার মাথায় টাক! কীভাবে তোমার মাথায় টাক পড়িয়াছে? মনে হয়, তুমি কাহারো আতরের শিশি ঢালিয়া ফেলিয়াছ। লোকে তোতার এই কথা শুনিয়া হাসিয়া উঠিল এবং বলিল, দেখো, এই তোতা দরবেশকেও নিজের মত মনে করিয়াছে যে, এই ব্যক্তিও আমার ন্যায় আতর ফেলিয়া দিয়াছে। তাহাতে মার খাইয়া মাথার চুল উঠিয়া গিয়াছে।
কারে পাকাঁরা কিয়াছ আজ খোদ মসীর,
গারচে মানাদ দর নাবেস্তান শের ও ছির।
জুমলা আলম জেইঁ ছবাব গোমরাহ্ শোদ্,
কমকাছে জে আবদালে হক্কে আগাহ্ শোদ।
আশকিয়ারা দীদায়ে বীনা নাবুদ,
নেক ও বদ দর দীদাহ্ শানে একছাঁ নামুদ।
হামছেরী বা আম্বিয়া বর দাস্তান্দ,
আওলিয়ারা হামচু খোদ পেন্দাস্তান্দ।
গোফ্তে ইঁনাফ মা বাসার ইঁশাঁ বাসার,
মাও ইঁশাঁ বস্তাহ্ খা বীমো খোর।
ইঁ নাদানেস্তান্দ ইঁশাঁ আজ আমা,
হাস্তে ফরকে দরমিয়ানে বে মুনতাহা।
অর্থ: তোতা পাখির ঘটনা উল্লেখ করার পর মাওলানা পাঠকদিগকে উপদেশ দিতে যাইয়া বলিতেছেন, বুজর্গ লোকের কাজ দেখিয়া নিজের কাজের উপর ’কিয়াস’ করিওনা। কেননা, খেয়াল করিয়া দেখ, যদিও শব্দ ‘শীর’ ও ‘সীর’ লিখনে একই বানান, কিন্তু অর্থের দিক দিয়া দিন-রাত পার্থক্য। শীর অর্থ দুধ। আর সীর অর্থ রসুন। এই রকম মানুষ হিসাবে যদিও বুজর্গ লোক ও অন্য লোক একই রকম দেখায়, কিন্তু আমলের দিক দিয়া অনেক পার্থক্য আছে। তাই, নিজের উপর অন্যকে কিয়াস করা অথবা অন্যকে নিজের মত মনে করা ভুলের শামিল। হইতে পারে সে তোমার চাইতে উত্তম, অথবা তোমার চাইতে অধমও হইতে পারে। তাই, কাহাকেও কেহর ন্যায় অনুমান করা উচিত না। অধিকাংশ লোক ঐ রকম মনে করে বলিয়া পথভ্রষ্ট হইয়া গিয়াছে। তাহারা আওলিয়াদের অবস্থা সম্বন্ধে কিছুই জানিতে পারে নাই। বদলোকের চক্ষে দেখিবার শক্তি নাই। তাহারা ভাল ও মন্দকে একই রকম দেখে। এইজন্য কাফেরেরা আম্বিয়া আলাইহেচ্ছাল্লাম-গণকে নিজের সমতুল্য মনে করিয়া বলিত, নবীগণ মানুষ, আমরাও মানুষ। তাহারা খায়, ঘুমায়; আমরাও খাই, ঘুমাই। তাহাদের মধ্যে ও আমাদের মধ্যে পার্থক্য নাই। কাফেরদের অন্তর ত্যাড়া-বাঁকা ছিল বলিয়া নবীদের মোজেজা ও কার্যকলাপ চক্ষে ধরা পড়িত না। আম্বিয়া আলাইহিচ্ছাল্লাম ও সাধারণ মানুষের মধ্যে সীমাহীন পার্থক্য বিদ্যমান রহিয়াছে। দেখিবার মত শক্তি চক্ষে না থাকিলে কাহারও দোষ দেওয়া চলে না।
হর দো এক গোল খোরাদ জাম্বুর ও নহল,
লেকে জীইঁ শোদ নেশও জাঁ দীগার আছল।
হর দো গুণ আহু গেয়া খোরদান্দ ও আব,
জীইঁ একে ছারগীন শোদ ও জাঁ মেশকে নাব।
হরদো নে খোরদান্দ আজ এক আবখোর,
আঁ একে খালি ও আঁ পুর আজ শাকার।
ছদ হাজারানে ইঁ চুনিঁ আশবাহ বী,
ফরকে শানে হাফতাদ ছালাহ্ রাহ্ বী।
অর্থ: উপরোক্ত ভাব সম্প্রসারণ করিতে যাইয়া মাওলানা কয়েকটি দৃষ্টিন্ত দিয়া বলিতেছেন, মৌমাছি ও বল্লা দুইটি পোকা একই ফুল হইতে মধু পান করে। কিন্তু একটিতে শুধু কাটিতে জানে, অন্যটি মধু দান করে। দ্বিতীয় উদাহরণ, দুই প্রকার হরিণ প্রত্যেকেই জঙ্গলের ঘাস খায় ও পানি পান করে। এক প্রকারে শুধু লাদই পায়খানা করে। অন্য প্রকার হইতে মেশকে আম্বর পাওয়া যায়। তৃতীয় উদাহরণ, একই স্থানের মাটির রস পান করিয়া দুই প্রকারের গাছে বিভিন্ন ফল প্রদান করে; যেমন, নারিকেল গাছে নারিকেল দেয় এবং খেজুর গাছে সুমিষ্ট রস দান করে। এই রকম শত সহস্র উদাহরণ দেখা যায় এবং উহাদের মধ্যে অনেক পার্থক্য বিদ্যমান। অতএব, ইহা পরিষ্কারভাবে বুঝা গেল যে দুইটি বস্তু বা প্রাণী কোনো কোনো দিক দিয়া এক হইলেও অন্যদিক দিয়া পার্থক্য থাকে।
ইঁ খোরাদ গরদাদ পলিদী জু জুদা,
ও আঁ খোরাদ গরদাদ হামা নূরে খোদা।
ইঁ খোরাদ জে আইয়াদ হামা বুখলো ও হাছাদ,
ও আঁ খোরাদ জে আইয়াদ হামা ইশ্কে আহাদ।
অর্থ: মাওলানা বলেন, এইভাবে বুঝিয়া লও যে নেক্কার বদকারের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। বদকার খায়, ঘুমায়, তাহার মধ্যে অপবিত্র ও অন্যায় বৃদ্ধি পায়। অন্তরে কৃপণতা ও হিংসা বাড়িয়া যায়। নেক্কার পানাহার করে; তাঁহার খোদার মহব্বত বৃদ্ধি পায়।
ইঁ জমিন পাক ও আঁ শু রাহাস্ত ও বদ,
ইঁ ফেরেস্তা পাক ও আঁ দেওয়াস্ত ও দাদ।
হরদো ছুরাত গার বাহাম মানাদ রওয়াস্ত,
আবে তলখো ও আবে শিরিন রা ছেফাত।
জুযকে ছাহেবে জওকে নাশে নাছাদ শরাব,
উ শেনাছাদ আবে খোশ আজ শুরাহ্ আব।
জুযকে ছাহেবে জওক নাশে নাছাদ তাউম,
শহদরা নাখোরদাহ্ কে দানাদ জে মুম।
অর্থ: এখানেও মাওলানা নেক্কার ও বদকারের পার্থক্য বর্ণনা করিয়াছেন। তিনি বলেন, নেক ব্যক্তি পাক জমিনের ন্যায়। আর বদকার লবণাক্ত জমিনের মত। এইরূপভাবে একজন নেক্কারকে ফেরেস্তার সহিত তুলনা করা যাইতে পারে। এবং বদকারকে শয়তান বা হিংস্র জন্তুর সাথে তুলনা করা যায়। এরূপ পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও যদি প্রকাশ্যে যে কোনো দিক দিয়া সামঞ্জস্য থাকে, তবে তাহা অসম্ভব নহে। যেমন মিঠা পানি ও লবণাক্ত পানির মধ্যে কত পার্থক্য। প্রকাশ্যে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার দিক দিয়া যদিও একই রকম হয়। কিন্তু স্বাদ ও মজার পার্থক্য অনুভব করা সকলের পক্ষে সম্ভব নয়। যাহার স্বাদ গ্রহণের শক্তি ঠিক আছে, সেই-ই ইহা পার্থক্য করিতে পারিবে যে, কোন্ পানি মিঠা আর কো্ পানি লবণাক্ত। এই রকম মুম এবং মধুর স্বাদের পার্থক্য ঐ ব্যক্ত করিতে পরিবে, যে ইহা পান করিয়োছে এবং খাইয়াছে, সে ব্যতীত কেহই অনুমান করিতে পারিবে না।
অতএব, যাহার মধ্যে ইশ্কে মারেফাতের অভ্যন্তরীণ শক্তি সতেজ ও প্রখর না হইবে, সে কখনও নেক ও বদকারের পার্থক্য করিতে পারিবে না।
ছেহের্ রা বা মোজেজাহ্ করদাহ্ কিয়াছ,
হরদোরা বর মকর পেন্দারাদ আছাছ।
ছাহেরানে বা মূছা আজ ইস্তিজাহ্ হা,
বর গেরেফতাহ্ চুঁ আছায়ে উ আছা।
জিইঁ আছা তা আঁ আছা ফরকিস্ত জরফ,
জিইঁ আমল তা আঁ আমল রাহি শগরাফ।
লায়নাতুল্লাহে ইঁ আমল রা দর কাফা,
রহ্মাতুল্লাহে আ আমল রা দর ওফা।
অর্থ: এখানে প্রকাশ্যে কাজ দেখিয়া অনুমান করা ভুল। এই সম্বন্ধে মাওলানা বলেন, ফেরাউন যাদুবিদ্যা এবং নবীদের মোজেজাকে এক রকম বলিয়া ধারণা করিয়াছে এবং উভয় কাজকেই ধোকাবাজী ও সম্মোহন বলিয়া ধারণা করিয়াছে; এইজন্য ফেরাউনের যাদুকরগণ হজরত মুসা (আঃ)-এর লাঠির সম্মুখে তাহাদের লাঠি নিয়া প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিতে উদ্যত হইয়াছিল। কিন্তু লাঠিদ্বয়ের মধ্যে দিন-রাত পার্থক্য ছিল। হজরত মুসা (আঃ)-এর আমল এবং যাদুকারদের আমলের মধ্যে তুলনা ছিল না। যাদুকারদের আমলের প্রতি খোদার অভিশাপ নাজেল হইত এবং হজরত মুসা (আঃ)-এর আমলের প্রতি খোদার রহমত নাজেল হইত। কেননা, তিনি খোদার হুকুম পালন করিয়াছিলেন। খোদাতায়ালা তাঁহাকে লাঠি জমিনে ফেলিয়া দিতে আদেশ করিয়াছিলেন।
কাফেরানে আন্দর মরে বুজিনা তাবায়া,
আফতে আমদ্ দরুণে ছীনা তামায়া।
হরচে মরদাম মী কুনাদ্ বুজিনা হাম,
আঁকুনাদ্ কাজ মরদে বীনাদ্ দমবাদম।
উ গুমান্ বোরদাহ কেমান্ করদাম চু উ,
ফরকে রাকায়ে দানাদ্ আঁ আস্তিজাহ্রু।
ইঁ কুনাদ্ আজ আমরে ও আঁবহ্রে ছাতীজ,
বর্ছারে আস্তিজাহ্ রুইয়ানে খাকে রীজ।
অর্থ: মাওলানা বলেন, কাফের লোক মোসলমানের কাজের সহিত বানরের ন্যায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। ইহাতে তাহাদের লালসার কারণে অন্ধকারাচ্ছন্ন হইয়া যায়। ইহাও এক প্রকার বিপদ। কেননা, ভবিষ্যতে আর কখনও প্রকৃত অবস্থা দেখিবার শক্তি হইবে না। বানর শুধু হিংসার বশবর্তী হইয়া মানুষে যাহা করে, তাহা অনুকরণ করে, এবং মনে করে যে আমিও মানুষের ন্যায় করিলাম। কিন্তু উভয় প্রকার কাজের মধ্যে যে পার্থক্য হয়, উহা কেমন করিয়া সে বুঝিবে? মানুষ তো খোদার নির্দেশ অনুযায়ী অথবা নিজের জ্ঞান দ্বারা হিতের জন্য কোন কাজ করে। চাই সে মঙ্গল শরিয়ত অনুযায়ী-ই হউক অথবা শরিয়তের বিরুদ্ধেই হউক। যে ভাবেই হউক, হয়ত পার্থিব মঙ্গল অথবা পরকালের মঙ্গলের জন্য চিন্তা করিয়া করে। কিন্তু বানরের কাজের মধ্যে ইহার কোনোটাই নাই। শুধু মানুষের অনুকরণ করাটাই তাহার উদ্দেশ্য। মাওলানা বলেন, এই প্রকার হিংসুক লোকের মুখের উপর ধুলি নিক্ষেপ করা উচিত। এইরূপভাবে সৎকাজ ও অসৎ কাজ প্রকাশ্যে একই রকম দেখায়। কিন্তু ফলাফল হিসাবে বহুৎ পার্থক্য দেখা যায়।
আঁ মুনাফেক্ বা মোয়াফে্কদর্ নামাজ,
আজ পায়ে ইস্তিজাহ্ আইয়াদ্ নায়ে নাইয়াজ।
দর নামাজে দর রোজায়ে ও হজ্জো জেহাদ,
বা মুনাফেক্ মোমেনানে দর্ বুর দোমাত।
মুমে নাঁরা বুরদে বাশদ্ আকেবাত,
বর মুনাফেক্ মাতে আন্দর আখেরাত।
গার্চে হরদো বরছারিয়েক্ বাজীয়ান্দ,
লেকে বাহাম মরুজী ও রাজিয়ান্দ।
হরিয়েকে ছুয়ে মাকামে খোদ্ রওয়াদ্,
হরিয়েকে বর উফুকে নামে খোদ্ রওয়াদ্।
অর্থ: উপরে যাহাদিগকে বানরের সহিত তুলনা করা হইয়াছে, এখানে তাহাদের সম্বন্ধে মাওলানা বলেন, মুনাফেকের দল মোসলমানদের সহিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিয়া রোজা-নামাজ আদায় করে। কোনো কোনো সময় মোনাফেকেরা জয়লাভ করে। কিন্তু শেষফল, পরকালে মুসলমানদেরই ভাগ্যে জয়লাভ হইবে এবং মোনাফেকদের অদৃষ্টে পরাজয়ের গ্লানি লিখা আছে। মুসলমানেরা বেহেস্তে চলিয়া যাইবে, আর মোনাফেকরা জাহান্নামের নিচু স্তরে পতিত হইবে।
মোমেনাশ খানেশে জানাশ খোশ শওয়াদ,
দর মোনাফেক তন্দোপুর আতেশ শওয়াদ।
নামে আঁ মাহবুবে আজ জাতে ওয়ায়ে আস্ত,
নামে ইঁ মাব্গুছ জআফাতে ওয়ায়ে আস্তে।
মীমো ও ওয়াও ওমীমো নূন তাশরীফে নীস্ত,
লফজে মোমেন জুয্ পায়ে তারীফে নিস্ত।
গার মোনাফেক খানেশ ইঁ নামে দূন,
হামচু কাসদম মী খালাদ দর আন্দরূন।
গার না ইঁ নামে ইশতে ফাকে দোজখাস্ত,
পাছ চেরা দর ওয়ায়ে মজাকে দোজখাস্ত।
অর্থ: মাওলানা “মোনাফেক” ও “মোমেন” শব্দদ্বয়ের তাৎপর্য বর্ণনা করিতে যাইয়া বলিতেছেন, যদি কোনো ব্যক্তিকে মোমেন বলা হয়, তবে সে অত্যন্ত খুশী হয়। আর যদি কাহাকেও মোনাফেক বলা হয়, তবে সে রাগে অগ্নিবৎ রূপ ধারণ করে। ইহার কারণ শুধু শব্দের পার্থক্যের কারণে নয়, বরং অর্থের কারণে। কেননা, মোমেন শব্দ যে লোকের নিকট প্রিয় উহা শব্দের খাতিরে নয়। উহার অর্থ দ্বারা যে গুণ বুঝা যায়, সেই গুণ বা সিফাত লোকের নিকট প্রিয়। আর “মোনাফেক” শব্দ শুধু শব্দের দিক দিয়া অপ্রিয় নয়। ইহার অর্থে যে সব দোষ প্রকাশ পায়, তাহা লোকের কাছে অপ্রিয় বলিয়া অসন্তুষ্ট হয়। অক্ষর মীম, ওয়াও, মীম এবং নূনের মধ্যে কোনো বুজর্গী নাই। “মোমেন” শব্দ শুধু ঐ প্রিয় সিফাত বা গুণের চিহ্ণ মাত্র। এইরূপভাবে কাহাকেও যদি মোনাফেক বলা হয়, তবে সে যে রাগান্বিত হয়, তাহা শুধু উক্ত কারণেই, অন্য কিছু নয়। কেননা, মোনাফেক শব্দ দ্বারা অপ্রিয় বস্তু বা দোষ বুঝায়, যাহা দোজখে যাইবার উপযুক্ত। দোজখীদের নামের জন্যই মোনাফেক শব্দ বানান হইয়াছে। এইজন্য মোনাফেক বলিলেই লোকে অত্যন্ত রাগান্বিত হয়।
জেছ্তি ইঁ নামে বদ আজ হর্ফে নীস্ত,
তল্খী আঁ আরে বহ্রে আজ জরাফে নীস্ত।
অর্থ: মাওলানা বলেন, শব্দের উক্ত ক্রিয়া শব্দ বা অক্ষরসমূহের ক্রিয়া নয়, বরং অর্থের ক্রিয়া। দ্বিতীয় লাইনে ইহার উদাহরণ দিয়া বলিতেছেন যে, শব্দ যেমন পেয়ালা আর অর্থ যেমন পানি। নদীর পানি যদি লবণাক্ত হয়, তবে নদীর কারণেই হয়। উহাতে পেয়ালার কোনো ক্রিয়া থাকে না। এইরূপভাবে শব্দ দ্বারা যে খারাপ বৈশিষ্ট্য বুঝা যায়, উহা শব্দের কারণে নয়, বরং অর্থের কারণেই খারাপ বলিয়া মনে হয়। শব্দের ক্রিয়া অর্থের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে না।
হরফে জরফে আমদ দরু মায়ানি চু আব,
বহ্রে মায়ানি ইন্দাহু উম্মুল কিতাব।
বহ্রে তল্খো ও বহ্রে শিরিন হাম উনান,
দরমিয়ানে শানে বজরখে লাইয়াবগিয়ান,
ও আঁকে ইঁ হরদো জে এক আছলি রওয়ান
বরগোদাজ জিই হরদো রোতা আছল আঁ।
অর্থ: অক্ষরগুলি অর্থের পাত্রস্বরূপ। যেমন, পেয়ালা পানির পাত্র, সমুদ্র অর্থ ঐ পবিত্র জাত, যাহার নিকট ‘উম্মুল কিতাব’ আছে; অর্থাৎ আল্লাহ্তায়ালা। আল্লাহ্তায়ালাকে মাওলানা এখানে সমুদ্রের সহিত তুলনা করিয়াছেন। কেননা, সমুদ্র হইতে যে রকমে পানি সূর্য কিরণে বাষ্প হইয়া মেঘে পরিণত হয় এবং পরে বৃষ্টিরূপে জমিতে পতিত হইয়া পুনঃ ঐ পানি গড়াইয়া যাইয়া সমুদ্রের পানির সাথে মিলিত হয়, সেই রকম প্রত্যেক সৃ্ষ্ট বস্তু ও জীব আল্লাহর নিকট হইতে সৃষ্টি হইয়া আসে এবং শেষ পর্যন্ত আল্লাহ্র নিকটই প্রত্যাবর্তন করে। আল্লাহর নিকটই ‘উম্মুল কিতাব’ অর্থাৎ পবিত্র কুরআন মওজুদ আছে।
ভাব: ইহ-জগতের সৃষ্ট বস্তুসমূহ দেখিয়া সৃষ্টিকর্তার জাতের দিকে লক্ষ্য করিতে হইবে। বস্তুসমূহ হইতে খেয়াল ফিরাইয়া আল্লাহ্র প্রতি খেয়াল নিবদ্ধ করিতে হইবে। তাঁহার রং-বেরংয়ের কুদরত এবং নানা প্রকার শিল্পের রহস্য বুঝিতে চেষ্টা করিবে। প্রত্যেক বস্তুর পার্থক্য আয়ত্ত্ব করিতে শিখিবে। লবণাক্ত দরিয়া অর্থাৎ খারাপ বৈশিষ্ট্য এবং মিষ্টি পানি দরিয়া অর্থাৎ উত্তম গুণাবলী উভয়েই প্রকাশ্যে একইভাবে প্রবাহিত হইতেছে। কোনো কোনো সময়ে একই রকম বলিয়া সন্দেহ হইয়া যায়। যেমন বদান্যতা ও অযথা খরচ। কৃপণতা ও মিতব্যয়ী পরস্পর একই রকম বলিয়া মনে হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এক নয়। ইহার মাঝখানে এমন একটি আবরণ আছে, যাহার দরুন একই বলিয়া বিবেচিত হইতে পারে না। ঐ স্তবক এমন একটি গুণ, যাহা দ্বারা সদৃশ বস্তুর পার্থক্য করা সহজ হইয়া পড়ে। যেমন, বদান্যতা দ্বারা অপরের উপকার সাধিত হয়। আর অপব্যয় দ্বারা নিজের আত্মার গরিমা বৃদ্ধি পায়। এই রকম অন্যান্য গুণের মধ্যেও পার্থক্য করা চলে। কিন্তু উভয়েই এক আল্লাহর সৃষ্ট, আল্লাহর নিকট হইতে প্রবাহিত হইবার শক্তি পায়। অতএব, এইসব গুণাগুণ সৃষ্টির রহস্য অনুধাবণ করিয়া আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করা অতি সহজ।
জরে কল্বো ওজরে নেকো দর ইয়ার,
বে মাহাক্ হরগেজ না দারাদ ইতেবার।
হরকেরা দর জানে খোদা বনেহা মাহাক,
মর ইয়াকিন রা বাজে দানাদ উ জে শাক।
আঁকে গোফ্ত ইছ তাফতে কলবাকা মোস্তাফা,
আঁকাছে দানাদ কে পুর বুদ আজওফা,
দরদেহানে জেন্দাহ্ খাশা কে জেহাদ,
আঁগাহ্ আর আমদ কে বেরুনাশ নেহাদ
দর হাজারাণে লোকমাহ্ এক খাশাক খোরদ,
চুঁ দর আমদ হেচ্ছে জেন্দাহ্ পায়ে বা বোরদ।
অর্থ: মাওলানা পুনঃ ভাল-মন্দ পরিষ্কার করিয়া বুঝাইয়া দিবার চেষ্টা করিতেছেন। তিনি বলেন, নেক ও বদের দৃষ্টান্ত হইতেছে যেমন খাঁটি স্বর্ণ ও ভেজালযুক্ত স্বর্ণ দেখিতে একই রংয়ের দেখায়। কিন্তু মূলতঃ অনেক পার্থক্য থাকে। পরখ করার জন্য কষ্টিপাথরের দরকার। ঐ রকমভাবে নেক ও বদ জানার জন্য জ্ঞানের আলো আবশ্যক। আল্লাহ্তায়ালা যাহার অন্তরে জ্ঞানের আলো দান করিয়াছেন, তিনি এই সমস্ত ভাল মন্দের গুণাগুণ বুঝিয়া লইতে পারেন। যেমন, নবী করিম (দঃ) ফরমাইয়াছেন – “তোমার যদি কোনো কাজ বা ঘটনায় সন্দেহ হয়, তবে তুমি তোমার অন্তরের আলো দিয়া উহা দেখ, তোমার অন্তরে যাহা ভাল মনে কর, সেই অনুযায়ী আমল কর।” কিন্তু, ইহা সবের জন্য নহে। বরং ঐ ব্যক্তির জন্য, যে ব্যক্তি খোদার আদেশ-নিষেধ পূর্ণভাবে পালন করেন এবং সর্বদা শরিয়াতের পা-বন্দী থাকেন। ঐরকম ব্যক্তি-ই নূরে এলাহী প্রাপ্ত হন, ইহাতে তাঁহার অন্তঃকরণ পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন থাকে। সন্দেহের স্থলে সঠিক রায় দিতে পারেন। যেমন, জীবিত ব্যক্তির খানার মধ্যে যদি কোনো খড়-কুটা মিশ্রিত হইয়া লোকমার (গ্রাসের) সাথে মুখে যায়, তবে যেহেতু তার অনুভূতি শক্তি জীবিত আছে, স্পর্শ শক্তি দ্বারা হঠাৎ ধরিয়া ফেলিতে পারে, এবং সহজেই বাহির করিয়া ফেলে। এই রকমভাবে পবিত্র আত্মার ব্যক্তি সদা-সর্বদা খোদার নিকট হইতে আলো প্রাপ্ত হইতে থাকেন। উহা দ্বারা সন্দেহযুক্ত বিষয়ের ফায়সালা অতি সহজেই করিয়া ফেলিতে পারেন।
হেচ্ছে দুনিয়া নরদে বানে ইঁ জাহান,
হেচ্ছে উক্রা নরদে বানে আছে মান।
ছেহাতে ইঁ হেচ্ছে ব জুইয়াদ আজ তবীব,
ছেহাতে আঁ হেচ্ছে ব জুইয়াদ আজ হাবীব।
ছেহাতে ইঁ হেচ্ছে জে মায়া মুরিয়ে তন
ছেহাতে আঁ হেচ্ছে জে তাখ্রীবে বদন।
অর্থ: উপরে উল্লেখ করা হইয়াছে যে, স্পর্শ শক্তি দ্বারা বাহ্যিক বস্তুসমূহ উপলদ্ধি করা যায়। কিন্তু, আধ্যাত্মিক বস্তুসমূহ অনুধাবন করার জন্য অন্তরের শক্তির দরকার। অতএব, মাওলানা এখানে আধ্যাত্মিক অনুভূতি এবং ইহার ফজিলত সম্বন্ধে বলিতেছেন, জাগতিক স্পর্শ শক্তি দ্বারা পার্থিব বস্তুসমূহ পার্থক্য করিতে পারেন। কিন্তু আধ্যাত্মিক শক্তি ছাড়া পরকালের কিছুই হাসিল করা যায় না। আধ্যাত্মিক শক্তি অর্থ নূরে ইলাহী। আল্লাহর নূর-ই হইল পরকালের বিষয়বস্তু হাসিল করার অস্ত্র। অতএব, পরকালের শান্তি পাইতে হইলে ইহ-কালেই মারেফাতের আলো অন্তরে সঞ্চয় করিতে হইবে। ইহ-জগতে যেমন শরীর সুস্থ রাখার জন্য বিজ্ঞ ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র দরকার, তেমনি পরকালে আত্মার শান্তি পাইতে হইলে এখনই পীরে কামেলের পরামর্শানুযায়ী চলা আবশ্যক।
শাহে জানে মর জেছে মরা বীরাণ কুনাদ্,
বাদে বীরানাশ আবাদে আঁ কুনাদ্।
আয় খনকে জানে কে দর ইশ্কে মাল,
বজ্লে করদে উ খানে মানো মুলকো মাল।
করদে বীরাণ খানা বহ্রে গঞ্জে জর,
ওয়াজ হুমাঁ গঞ্জাশ কুনাদ মায়া মুর তর।
অর্থ: মারেফাতের আলো পাইবার জন্য প্রথমে পীরে কামেলের আদেশ অনুযায়ী শরিয়ত মোতাবেক যে সমস্ত রিয়াজাত ও মোশাহেদাত করিতে হয়, ইহাতে যদি শরীরের ক্ষতিও সাধন হয়, তবে ভীত হইবার কোনো কারণ নাই। কেননা, আল্লাহতায়ালা প্রথমে শরীরকে খারাপ করিয়া দিবে, পুনঃ ইহাকে রূহানী শক্তি দ্বারা সতেজ করিয়া তুলিবে এবং রূহানী হায়াত মিলিবে। ইহাতে শরীর ও প্রকৃত শান্তির জীবন পাইবে। কেননা, রূহানী হায়াতের দরুণ মুক্তি পাইবে এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভ করিতে পারিবে। চিরকাল চিরশান্তিতে বেহেস্তে বাস করিতে পারিবে। উক্ত নেয়ামত এই শরীরের মারফতেই প্রাপ্ত হইবে। তারপর মাওলানা বলেন, যে ব্যক্তি পরকালে স্থায়ী শান্তির জন্য নিজের ইহকালের সমস্ত ধনদৌলাত খরচ করিয়া ফেলে, সে অতি উত্তম। পরকালের সামান (সামগ্রী) সে সজ্জিত করিয়া রাখিল। আখেরাতে বিপদের জন্য তাহাকে কোনো চিন্তাই করিতে হইবে না। শরীর খারাপ হওয়া এবং রূহ্ তাজা হওয়া সম্বন্ধে মাওলানা কয়েকটি উদাহরণ দিয়া দেখাইয়াছেন যে, যদি কাহারো ঘরের নিচে গচ্ছিত ধন থাকে, তবে ঐ ধন ঘর খুঁড়িয়া বাহির করিয়া ঐ সম্পদ দিয়া পুনরায় ঘর উত্তমরূপে মেরামত করিলে অতি সুন্দর হয়।
আবেরা বা বুরীদ ওয়াজুরা পাকে করদ,
বাদে আজ আঁ দর জুরে ওয়াঁ করদে আব খোরদ্।
পুস্তেরা বশে গাফ্ত পেকানেরা কাশীদে,
পুস্তে তাজাহ্ বাদে আজানাশ বর দমীদ।
কেলায়া বীরাণ করদ ওয়াজ কা ফেরেস্তাদ,
বাদে আজাঁ বর ছাখতাশ ছদ বুরজোছদ।
অর্থ: মাওলানা দ্বিতীয় উদাহরণ পেশ করিতেছেন যে, কোনো নহরের পানি কয়েকদিনের জন্য বন্ধ করিয়া উহা উত্তমরূপে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করিয়া ঠিক করিয়া দিয়া তারপর উপর হইতে পানি প্রবাহিত করাইয়া দিলে ভাল হয়। তৃতীয় দৃষ্টান্ত, কাহারও শরীরে যদি তীরের লোহা ঢুকিয়া যায়, চামড়া কাটা ব্যতীত উহা বাহির করা সম্ভব না হয়, তখন চামড়া ফাঁড়িয়া লোহা বাহির করা হইল। এখন চামড়া ফাঁড়া ও ইহাতে যে কষ্ট হইল, উহা কয়েকদিন পর চামড়া জোড়া লাগিলে ও ব্যথা কমিয়া গেলে স্থায়ী শান্তি পাওয়া যায়। চতুর্থ মেসাল – যেমন, কোনো দুর্গ কাফেরদের দখলে আছে। অবরোধ করার সময়ে তোপ দিয়া ভাঙ্গিয়া চুরমার করিয়া ফেলা হয়। ভিতরে ঢুকিয়া শত্রু হত্যা করিয়া দুর্গ দখল করিয়া পরে শত শত গম্বুজ তৈয়ার করিয়া বহু দেয়াল নির্মাণ করা হয়। উপরোক্ত দৃষ্টান্তসমূহ দ্বারা বুঝা যায় যে, প্রথমে একদম ক্ষতি ও নোক্সান স্বীকার করিতে হয়। যে ব্যক্তি পরিণতি সম্বন্ধে অজ্ঞ, তাহর মন অসন্তুষ্ট হইয়া পড়ে। কিন্তু এইরূপ ক্ষতি ও ধ্বংসের মধ্যে প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত মঙ্গল নিহিত আছে। কেননা, সামান্য ক্ষতি স্বীকার করিয়া অধিক মুনাফা লাভ করা যায়, ভবিষ্যত মঙ্গলের জন্য বর্তমান ক্ষতি স্বীকার করার বিধান আছে। এইরূপভাবে শরীরের ক্ষতি স্বীকার করিয়া রূহের জীবনী শক্তি বৃদ্ধি করা উচিত।
কারে বে চুঁ রাকে কাইফিয়াত নেহাদ,
ইফে গোফ্তাম আজ জরুরাত মীজেহাদ।
গাহ্ চুনিইঁ ব নোমাইয়েদ ওগাহ্ জেদ্দেই,
জুজকে হয়রাণি নাবাশদ কারে দীন।
কামেলানে কাজ ছের্রে তাহ্কীকে আগাহান্দ,
বে খোদ ও হয়রান ও মস্তো আলাহান্দ।
অর্থ: মাওলানা বলেন, আল্লাহর মহব্বত হাসিল করার জন্য বান্দার চেষ্টা করা চাই। ঐ চেষ্টার পদ্ধতি হইল রিয়াজাত ও মোজাহেদাহ্। ইহা বান্দার জন্য শর্ত। অর্থাৎ, বান্দা রিয়াজাত ও মোজাহেদা করিতে করিতে আল্লাহর মহব্বত পাইতে পারে। কিন্তু, আল্লাহর জন্য বান্দার অন্তরে ইশ্কে এলাহি ঢালিয়া দিতে কোনো অসিলার দরকার হয় না। আল্লাহতায়ালা কোনো কাজের প্রশ্নে ‘কেন’ বা ‘কী করিয়া’র ধার ধারেন না। তিনি যাহা ইচ্ছা করেন, তাহা তখনই হইয়া যায়; কোনো কিছু শর্ত-মর্তের মুখাপেক্ষী নহেন। তাই মাওলানা বলিতেছেন, খোদার কাজের অবস্থা ও পদ্ধতি কে ঠিক করিতে পারে? তিনি বান্দাহ্কে কীভাবে গ্রহণ করিবেন, তাহা তিনি-ই জানেন। কিন্তু উপরে যে সব পদ্ধতির কথা বর্ণনা করা হইয়াছে, ইহা শুধু বান্দার আবশ্যকের জন্য। কেননা, মাহ্বুবের জন্য সর্বদা উদ্বেগ প্রকাশ করা চাই। ইহাই মাহ্বুবের দাবী।
খোদার মঞ্জুরী কোনো সময় একভাবে হয় না; এক এক সময় এক এক প্রকারে সম্পন্ন করেন। তাই দ্বীনের রাস্তায় হয়রানি ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না। সব সময়েই খোদার জন্য পেরেশান থাকিতে হয়। কোনো কোনো সময় প্রথম রিয়াজাত করিতে হয়। তারপর আল্লাহ্কে পাওয়া যায়। ইহাকে সালেহীনদের পথ বলে। আবার কোনো সময়ে আল্লাহর মহব্বত প্রথমেই পাইয়া থাকে। পরে রিয়াজাত ও মোজাহেদার জন্য আকাঙ্ক্ষা পয়দা হয়। ইহাকে জয্বার পথ বলে। এই অবস্থা সাধারণতঃ কোনো কামেল লোকের সাহচর্য অথবা কোনো বোজর্গ লোকের কাহিনী শুনিয়া অথবা খোদার ইচ্ছায় কোনো অসিলা ব্যতীতও অন্তরে খোদার ইশ্ক পয়দা হইতে পারে। তারপর আস্তে আস্তে রিয়াজাতের পদ্ধতির মধ্যে আসে। কামেল লোক যাহারা এই রহস্য অনুভব করেন, চাই নিজের মধ্যে হউক অথবা অন্য কাহারও মধ্যে দেখেন, তখন তাঁহারা সর্বদা হয়রান ও বেহুশ থাকেন।
নায়ে চুঁনা হয়রান কে পোস্তাশ ছুয়ে উস্ত,
বাল চুনিঁ হয়রান কে গরকে ও মস্তে দোস্ত।
আঁ একেরা রুয়ে উশোদ ছুয়ে দোস্ত,
ওয়া ইঁ এ কে বা রুয়ে উখোদ রুয়ে উস্ত।
অর্থ: মাওলানা বলেন, প্রকৃত কামেল ব্যক্তি আল্লাহর মহব্বতে বেহুশ থাকেন – ঐ রকম বেহুশ নয়, যাহারা আল্লাহর তরফ হইতে মুখ ফিরাইয়া রাখেন। অর্থাৎ, আল্লাহর মহব্বতের খেয়াল রাখে না। বরং কামেল লোক আল্লাহর ইল্মের মধ্যে ডুবিয়া হয়রান থাকেন। আল্লাহর ইশ্কে ডুবিয়া থাকা দুই প্রকার হইতে পারে। যেমন কেহ আল্লাহর মহব্বত চায়। অন্য প্রকার যেমন কেহ খোদ আল্লাহকেই চায়।
রুয়ে হরিয়েক মী নেগার মী দারে পাছ,
বুকে গরদী নূরে খেদমত রুশ নাছ।
দীদানে দানা ইবাদতে ইঁ বুদ,
ফত্হুল আবওয়াবে ছায়াদাতে ইঁবুদ।
অর্থ: মাওলানা বলেন, উপরোল্লিখিত দুই প্রকার অলি, আল্লাহর যে প্রকারই তোমার নসিবে মিলে প্রত্যেকের সহিত সাক্ষাৎ কর এবং তাঁহাদের সহিত আদব রক্ষা করিয়া চলো। তাঁহাদের খেদমত করো, তবে তুমি তাহাদিগকে খেদমত করার বরকতে আল্লাহর তরফ হইতে ইশ্কে নূর পাইতে পার। তারপর মাওলানা বলেন, কথিত আছে যে আলেমের সাথে সাক্ষাৎ করা ইবাদত। ঐ আলেমের অর্থ হইল আলেমে কামেল। মারেফাতে কামেল আলেমের সাথে সাক্ষাৎ করা ইবাদত-স্বরূপ। তাঁহাদের সেবা যত্ন করিলে নেক্বখ্তির দরজা খুলিয়া যায়। আল্লাহর নূর দেখিতে পাওয়া যায়।
খাঁটি কামেল পীর ও ভন্ড পীরের মধ্যে পার্থক্য করা
চুঁ বছে ইবলিছে আদম রুয়ে হাস্ত,
পাছ বহর দস্তে নাইয়া বদ দাদে দস্ত।
জাঁকে ছাইয়াদ আওরাদ বাংগে ছফীর,
তা পেরীবদ মোরগেরা আঁ মোরগে গীর।
বেশনুদ আঁ মোরগে বাংগে জেন্ছে খেশ,
আজ হাওয়া আইয়াদ বইয়াবদ দামোনেশ।
হরফে দরবেশাঁ বদ জাদ ও মরদে দূন,
তা বখানাদ বর ছলীমে জান ফেছুন।
অর্থ: অনেক শয়তান মানুষের সুরতে আছে। যেমন, আল্লাহ্তায়ালা নিজেও দুই প্রকার শয়তানের কথা বলিয়াছেন। এক প্রকার মানুষ জাতি শয়তান এবং অন্য প্রকার জিন জাতি শয়তান। এইজন্য পরীক্ষা ব্যতীত কাহারও হাতে বায়আত হইতে হইবে না।
মাওলানা উদাহরণ দিয়া বুঝাইতেছেন, যেমন শিকারীর কৌশল হইল, বনে শিকার করিতে যাইয়া জানোয়ারের ন্যায় আওয়াজ দেয়। জানোয়ারকে ধোকা দিয়া কাছে আনয়ন করে। ইহারা নিজ জাতির আওয়াজ শুনিয়া নিকটে আসে এবং জালে আবদ্ধ হইয়া কষ্টে পতিত হয়। ধোকাবাজ ভণ্ড পীরের স্বভাবও ঐ রকম। কামেল পীরের ন্যায় কথাবার্তা বলিয়া সভা গরম করে, যাহাতে সাদাসিধা মানুষদিগকে ধোকায় ফেলিতে পারে। সরল অন্তঃকরণ বিশিষ্ট মুখাপেক্ষী ব্যক্তি সহজেই ফাঁদে পড়িয়া আবদ্ধ হয় এবং পথভ্রষ্ট হইয়া জাহান্নামের পথিক হয়। অতএব, সাবধান! পীর পরীক্ষা না করিয়া কেহ পীর ধরিবে না।
কারে মর্দাঁ রওউশনি ও গর্মীয়াস্ত,
কারে দুনাঁ হীলা ও বেশরমীয়াস্ত।
অর্থ: মাওলানা বলেন, কামেল পীরের ঈমানের আলো ও আল্লাহর ইশ্ক আছে। ইতর মানুষের অভ্যাস শুধু ধোকাবাজী করা ও লজ্জাহীন কাজ করা।
ভাব: মাওলানা এখানে কামেল পীরের নমুনা সংক্ষেপে বর্ণনা করিয়াছেন। নিম্নে বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হইল। যেমন প্রকাশ্য রোগের চিকিৎসার জন্য বিজ্ঞ চিকিৎসকের দরকার এবং তাহার নিজের শরীর সুস্থ ও সবল থাকা আবশ্যক। কেননা, চিকিৎসক নিজে যদি রোগী হয়, তাহা হইলে চিকিৎসার সঠিক বিধান দিতে পারিবে না। কেননা, ডাক্তারী বিধান আছে, “রোগীর বিধানও রোগী।” চাই সে বিজ্ঞ ডাক্তার হউক, তাহার রায় ভরসাযোগ্য নয়। এবং যদি চিকিৎসক সুস্থ ও সবল হয়, কিন্তু সে চিকিৎসাবিদ্যা জানে না, তাহার রায়ও কার্যকরী নহে। এই রকমভাবে অভ্যন্তরীণ রোগের জন্য এমন পীরে কামেলের দরকার, যে নিজে মোত্তাকী ও নেককার এবং ফাসেক ও বদকার নয়। অন্যকেও ভাল করিতে জানে। আর যদি পীর বদকার ও বদ আকিদার হয়, তবে তাহার উপর কেহ বিশ্বাস স্থাপন করিতে পারে না যে, সে অপরকে ভাল করিতে পারে। বরং ধারণা জন্মিবে, সে যেমন নিজে বদ অপরকেও সেই রকম বদ বানাইতে চেষ্টা করিবে। অপরকে সৎকাজের উপদেশ দিবে না। কারণ নিজে মনে করিবে – আমি যখন আমল করি না, অপরকে করিতে বলিলে সে আমাকে মনে মনে কী বলিবে? বরং সে নিজে ভাল থাকিবার জন্য বদ আমলকে নেক আমল বলিয়া দেখাইতে চেষ্টা করিবে। ইহাতে গোমরাহী আরও বাড়িয়া যাইবে। ইহা ছাড়া বদকারের শিক্ষায় কোনো ক্রিয়া হয় না, আল্লাহর রহমত নাজেল হয় না। ঐ রকমভাবে যদি নিজে নেককার হয় এবং নেক আমল করে; কিন্তু বাতেনী শিক্ষা দেওয়ার পদ্ধতি না জানে, তবে তাহার দ্বারাও তালেব (অন্বেষণকারী) উপকৃত হইতে পারিবে না। অতএব, পীরে কামেল এমনভাবে হইতে হইবে যে, নিজে নেককার ও নেক আমল করে। নেককার কামেলের সাহচর্যে অনেক দিন পর্যন্ত থাকিয়া তাঁহার খেদমত করিয়া উকৃত হইয়াছে এবং বহু বিজ্ঞ কামেল লোকে তাঁহার প্রশংসা করে; এমন ব্যক্তির নিকট ইল্মে মারেফাত শিক্ষা করিতে হইবে। তবেই অন্তরে আল্লহর মহব্বত সৃষ্টি হইবে। আল্লাহর তরফ হইতে অন্তরে আলো প্রাপ্ত হইবে।
শেরে পশমীন আজ বরায়ে গাদ কুনান্দ,
বু মুছাইলাম রা লকবে আহ্ম্মদ কুনাদ।
বু মুছাইলাম রা লকবে কাজ্জাব মানাদ,
মর্ মোহাম্মদ রা উলুল আলবাব মানাদ।
আঁ শরাবে হক্কে খাত্তামাশ মেশকে নাব,
বাদাহ্ রা খাত্তামাশ বুদ গান্দো আজাব।
অর্থ: মাওলানা বলেন, মিথ্যা ভণ্ড পীর নেক্কার লোকের বেশ ধরিয়া দুনিয়ার অর্থ উপার্জনের জন্য ঘুরিয়া বেড়ায়। অশিক্ষিত জনসাধারণ তাহাকে প্রকৃত কামেল লোক বলিয়া মনে করে। যেমন, মুসাইলামা ভণ্ড নবী দাবি করিয়া অজ্ঞ জনসাধারণকে ধোকায় ফেলিয়াছিল। অবশেষে মিথ্যুকের লজ্জিত হইতে হইয়াছিল এবং মৃত্যুবরণ করিতে বাধ্য হইয়াছিল। তাহার উপাধি পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ মিথ্যুক চিরদিন থাকিবে। আর আমাদের সত্য নবী হজরত মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) চিরদিনই সত্যের সাধক ও আল্লাহ্র প্রিয় বান্দা হিসাবে পরিচিত থাকিবেন।
তিনি মোহরকৃত খাঁটি শরাব (শরবত)-এর ন্যায়। তাঁহার মোহর খুলিলেই সুগন্ধি চতুর্দিকে ছড়াইয়া পড়ে। নবী করিম (দঃ) যখন কথাবার্তা বলিতেন তখন সুগন্ধির ন্যায় চতুর্দিকে শান্তি ছড়াইয়া পড়িত। তাঁহার কথার রহস্য বুঝিতে পারিলে, মানুষ বেহুশ হইয়া যাইত।
এক ইহুদী বাদশাহ গোমরাহীর কারণে নাসারাদিগকে হত্যা করার কেচ্ছা
বুদ শাহে দরজহুদে আঁ জুলমে ছাজ,
দুশ্ মনে ঈছা ও নাছরানে গোদাজ।
আহাদে ঈছা বুদ ও নওবাতে আঁ উ,
জানে মুছ উ ও মুছা জানে উ।
শাহে আহ্ওয়াল কর্দ দর্রাহে খোদা,
আঁ দুদে মাছাজে খোদাই রা জুদা।
অর্থ: ইহুদীদের মধ্যে একজন জালেম বাদশাহ ছিলেন। তিনি হজরত ঈসা (আঃ)-এর শত্রু ছিলেন ও নাসারাদিগের ঘাতক ছিলেন। সে সময় হজরত ঈসা (আঃ)-এর নবুওয়াতের সময় ছিল। কিন্তু বাদশাহ ঈসায়ী দ্বীন মানিতেন না। হজরত মুসা (আঃ)-এবং ঈসা (আঃ) নবুওয়াতের দিক দিয়া এক ছিলেন। কিন্তু ঐ বাদশাহ নিজের গোমরাহীর দরুন ধর্ম সম্বন্ধে উভয়ের ধর্মকে পৃথক পৃথক করিয়া দেখাইতেন এবং হজরত মুসার (আঃ) ধর্ম সত্য বলিয়া প্রচার করিতেন ও হজরত ঈসা (আঃ)-এর ধর্ম মিথ্যা বলিয়া প্রকাশ করিতেন। প্রকৃত পক্ষে উভয় ধর্মই এক বলিয়া পবিত্র কুরআন সাক্ষ্য দেয়।
গোফ্তে উস্তাদ আহ্ওয়ালেরা কান্দার আ,
রু বরু আর আজ ওছাকে আঁ শিশারা।
চুঁ দরুঁ রফ্ত আহ্ওয়ালে আন্দার খানা জুদ,
পিশা পেশে চশ্মে উ দুমী নামুদ।
গোফ্তে আহ্ওয়ালে জাঁদু শিশা গো কুদাম,
পেশে তু আরাম বগো শারহাশ তামাম।
গোফ্তে উস্তাদ আঁদু শিশা নিস্তে রাও,
আহ্ওয়ালি বুগ্জার ও আফ্জুবিঁ মশো।
গোফ্তে আয় উস্তা মরা তায়ানা মজান,
গোফ্তে উস্তা জাঁ দু একরা দর শেকান।
চুঁ একে বশেকাস্ত হরদো শোদ জে চশ্মে।
মরদে আহ্ওয়াল গর্দাদ আজ মাইলানে ওখশমে।
শীশা একবুদ্ ও বচশমাশ দো নামুদ,
চুঁ শেকাস্ত উ শীশারা দীগার নাবুদ।
অর্থ: কোনো এক ওস্তাদ তাহার এক ত্যাড়া ছাত্রকে ঘরের মধ্যে যাইয়া একখানা আয়না আনিতে বলিলেন। ছাত্র ঘরের মধ্যে যাইয়া একখানা আয়নাকে দুইখানি দেখিল। ওস্তাদ সাহেবের কাছে আসিয়া বলিল, সেখানে দুইখানা আয়না আছে, কোন্ খানা আনিব? ওস্তাদ বলিলেন, দুইখানা নয়, একখানা; ত্যাড়ামি ছাড়িয়া দাও। ছাত্র বলিল, আপনি আমাকে দোষারোপ করিবেন না, সেখানে প্রকৃতপক্ষে দুইখানা আয়না আছে। ওস্তাদ বলিলেন, যদি দুইখানা থাকে, তবে একখানা ভাঙ্গিয়া ফেল, অন্যখানা নিয়া আস। ছাত্র যাইয়া যেই মাত্র একখানা ভাঙ্গিয়া ফেলিল, তখন আর অন্য খানাও দেখে না। মাওলানা বলেন, এইভাবে মানুষ নিজের স্বার্থের খাতিরে অথবা ক্রোধের বশবর্তী হইয়া ত্যাড়া হইয়া যায়। ভুল পথে চলে। আয়না একখানাই ছিল, কিন্তু ত্যাড়ামির কারণে দুইখানা দেখা যাইত।
এই রকমভাবে মানুষের অন্তঃকরণ যদি লোভের কারণে অথবা অন্য কোনো স্বার্থ সিদ্ধির জন্য বাঁকা হইয়া যায়, তাহা দ্বারা কোনো সময়ই সঠিক পথ অবলম্বন করা যায় না।
চশ্মো ও শাহ্ ওয়াত মরদরা আহ্ওয়াল কুনাদ,
জে ইস্তেকামাত রূহেরা মোবদাল কুনাদ।
চুঁ গর্জে আমদ হুনার পুশিদাহ্ শোদ,
ছদ্ হেজাব আজ দেল বছুয়ে দীদাহ্ শোদ,
চুঁ দেহাদ কাজি ব দেল রেশওয়াত কারার,
কায়ে শেনাছাদ জালেমে আজ মাজলুমে জার।
অর্থ: ক্রোধ এবং লালসা মানুষকে ভুল পথে ধাবিত করে। আত্মাকে স্থির থাকিতে দেয় না, অন্তরে বে-কারারী আসে। কেননা, এই দুইয়ের কারণে স্বার্থপরতা অধিক বৃদ্ধি পায়। সৎবুদ্ধি লোপ পায়। জ্ঞানের উপর হাজার হাজার আবরণ আসিয়া পড়ে। সৎপথ হইতে অন্ধ হইয়া যায়। অন্তঃকরণ অন্ধ হইয়া সং ও ন্যায় দেখিতে পায় না। অন্তঃকরণের দিক দিয়া চক্ষুও অন্ধ হইয়া যায়। কেননা, অনেক সময় অন্তরের সাথে চক্ষুর যোগাযোগ আছে। যেমন, কোনো কাজী সাহেব যদি ঘুষ গ্রহণ করিয়া বসে, তবে ন্যায়কারী ও অন্যায় কারীকে পার্থক্য করিতে পারে না।
শাহে আজ হেক্দে জহুদানা চুঁনান,
গাস্থে আহ্ওয়াল কালামানে ইয়া রাব্বে আমান
ছাদ হাজারানে মোমেন মাজলুম গাস্ত,
কে পানাহ্ হাম দীনে মূছা রাও পাস্ত।
অর্থ: ঐ বাদশাহ হিংসা ও গোমরাহীর দরুণ এরূপ অন্ধ হইয়া ভুল পথে গিয়াছিল যে, আল্লাহর লক্ষ লক্ষ মুমিন বান্দাকে হত্যা করিয়াছিলেন এবং নিজে ধারণা করিতেন যে, হজরত মূসা (আঃ)-এর ধর্মের সাহায্য করিতেছেন। ইহুদীরা হিংসায় এবং ক্রোধে অত্যন্ত কঠিন হয়। ইহুদীদের মত নিষ্ঠুর জাতি আর দুনিয়াতে নাই।
এক বুদ্ধিমান উজির কর্তৃক গোমরাহ্ বাদশাহ্কে ধোকা দেওয়া
আঁ উজিরেয় দাস্তেগেবরু ও উশ্ওয়াহ দেহ্ ,
কো বর আবে আজ মক্কর বরস্তে গেরাহ্।
গোফ্তে তরছায়ানে পানাহে জান কুনান্দ,
দীনে খোদরা আজ মালেক পেনহা কুনান্দ।
কমকোশ ইঁশারা কে কোস্তানে ছুদে নিস্ত,
দীনে নাদারাদ বুয়ে মেশ্ক ও উদে নিস্ত।
ছেররে পেনহাস্ত আন্দর ছাদ গেলাফ্,
জাহেরাশ বা তুস্ত ও বাতেন বরখেলাফ।
অর্থ: ঐ বাদশাহর একজন সুচতুর উজির ছিল। কথায় বলে, সে এমন চতুর ও চালাক ছিল যে পানির উপর গিরা দিতে পারিত। সে বলিল, নাসারাগণ নিজেদের প্রাণ রক্ষার জন্য নিজের ধর্ম অন্তরে গুপ্ত রাখিবে। অতএব, তাহাদিগকে হত্যা করা বন্ধ করুন, হত্যা করায় কোনো উপকার হইবে না। ধর্মের মধ্যে এমন কোনো সুগন্ধি নাই, যাহার ঘ্রাণ লইয়া অনুভব করা যাইবে যে তাহার ধর্ম কী? ধর্ম অন্তর্নিহিত বস্তু। উহা প্রকাশ্যে অনুভব করা মুশকিল। হয়ত আপনার সাথে প্রকাশ্যে আপনার ধর্মের কথা প্রকাশ করিবে। অন্তরে উহার বিপরীত থাকিবে। আপনি কেমন করিয়া উহা অনুমান করিবেন? এইরূপভাবে নাসারাগণ প্রকাশ্যে আপনার ধর্ম স্বীকার করিবে, কিন্ত তাহাদের অন্তরে নিজেদের ধর্ম থাকিবে। আতএব, আপনি কিছুতেই নাসারার ধর্ম বিলোপ করিতে পারিবেন না। এখন হইতে অসহায় নাসারাদিগকে হত্যা করা বন্ধ করুন।
শাহে গোফ্তাশ পাছ বগো তদবীরে চিস্ত,
চারাহায়ে ইঁ মক্কর ওইঁ তাজবীরে চীস্ত।
তা নামানাদ দর জাহাঁ নাছরাণী,
নায়ে হো বদা দীনো নায়ে পেনহানী।
অর্থ: বাদশাহ্ উজিরকে বলিলেন, তবে তুমি বল, এই মক্করবাজী ও ধোকাবাজীর কী তদবীর হইতে পারে। যাহাতে এই পৃথিবীতে কোনো নাসারা ধর্মাবলম্বী মানুষ না থাকিতে পারে। চাই প্রকাশ্যে হউক অথবা গুপ্তভাবে হউক, কোনো ভাবেই নাসরাণী ধর্ম পৃথিবীতে থাকিতে পারিবে না।
গোফ্তে আয়শাহ্ গোশ ও দস্তামরা ববোর,
বীনাম বশেগাফ্ ও লবোদর হুক্মে মুর।
বাদে আজ আঁ দরজীরে দার আওয়ার মরা,
তা বখাহাদ এক শাফায়াগার মরা।
বর মোনাদী গাহ্ কুন ইঁকারে তু,
বর ছারে রাহে কে বাশদ চারে ছ।
আঁ গাহাম্ আজ খোদ বর আঁতাশহরে দূর।
তা দর আন্দাজাম দর ইঁশাঁ শার ও শোর।
কারে ইঁশাঁ ছার বছের শুরীদাহ গীর।
দরমীয়ানে শাঁ ফেতনা হায়ে আফ্গানাম,
কাহর মান হয়রান বমানাদ দরফানাম।
আঁচে খাহাম্ করদে বা নাছরা নীয়াঁ,
আঁ নমী আইয়াদ কনুঁ আন্দর বয়াঁ।
চুঁ শুমা রান্দাম আমীন ও মোক্তাদা,
দামে দীগার গুন নেহাম শানে পেশে পা।
ওয়াজে হীলে ব্ফেরেমে ইঁশাঁ রা হামাহ,
ওয়া আন্দার ইঁশাঁ আফগানাম্ ছাদ ও মদমাহ।
তা বদস্তে খেশে খুন খেশে তন,
বর জমীনে রী জানাদ কোতা শোদ ছুখান।
অর্থ: উজির বলিল, উহার তদবীর এই যে, আপনি কড়া হুকুম দিয়া আামার হাত ও কান কাটিয় ফেলুন। নাক এবং ওষ্ঠ ছিঁড়িয়া ফেলিয়া ফাঁসির কাষ্ঠের নিচে হাজির করিবেন। যাহাতে লোকে মনে করিবে যে, ইহাকে ফাঁসি কাষ্ঠে চড়ান হইবে। তারপর কেহ আমাকে সুপারিশ করিয়া ছাড়াইয়া নিবে। এই ঘটনা সর্বসাধারণের সম্মুখে বসিয়া হইতে হইবে। তারপর আমাকে আপনার নিকট হইতে বহুদূরে কোনো গ্রামে বাহির করিয়া দিবেন। তারপর দেখিবেন, আমি সেখানে বসিয়া নাসারানীদের মধ্যে কী মত ও পথ প্রকাশ করি। যখন তাহারা আমার ধর্ম গ্রহণ করিতে আরম্ভ করিবে, তখন মনে করিবেন যে তাহাদের ধর্ম বিলীন হইয়া গিয়াছে। তাহাদের মধ্যে এমন ফেতনা ঢালিয়া দিব, যাহাতে শয়তানেও আমার ধোকাবাজী সম্বন্ধে কিছু বুঝিয়া উঠিতে পারিবে না। মোট কথা, নাসারাদের মধ্যে যে সব কাজ করিব, তাহা এখন ভাষায় প্রকাশ করিতে পারিতেছি না। যখন তাহারা আমার উপর পূর্ণ আস্থা স্থাপন করিবে এবং আমাকে তাহাদের নেতা মনে করিবে, তখন তাহাদের সম্মুখে অন্য রকম আর একটা বিস্তার করিব। আমার ফেরেববাজীতে সকলেই ধোকায় পড়িয়া যাইবে। তাহাদের মধ্যে অনেক পাণ্ডা লাগাইয়া দিব, যাহাতে তাহারা পরস্পর মারামারি কাটাকাটি করিয়া মারা যায়, তবেই কেচ্ছা শেষ হইয়া যায়।
পাছ বগুইয়াম মান বা ছেররে নাছরানিয়াম,
আয়ে খোদায়ে রাজে দাঁ মী দানেম।
শাহে ওয়াকেফ গাস্ত আজ ঈমানে মান,
ওয়াজ তায়াচ্ছুব করদ্ কছ্দে জানে মান।
খাস্তাম তা দীনে জে শাহ্ পেন্হা কুনাম,
আচেঁ দীনে উস্ত জাহের আঁ কুনাম।
শাহে বুয়ে বোরাদ আজ আছরারে মান,
মোত্তাহেম শোদ পেশে শাহ গোফ্তারে মান।
গোফ্ত গোফ্তে তু চু দর নানে ছুজানাস্ত,
আজ দেলে মান তা দেলে তু রওজানাস্ত।
মান আজাঁ রওজানে বদীদাম হালে তু,
হালে তু দীদাম্ না নুশেম কালে তু।
অর্থ: উজির বলিল, যখন আমার অবস্থা এইরূপ করা হইবে, তখন আমি নাসারাদিগকে বলিব, আমি অন্তরে নাসারা ধর্ম গুপ্তভাবে পোষণ করিতেছিলাম। ইহার উপর আমি খোদার কসম করিয়া বলিব, হে খোদা! তুমি আলেমুল গায়েব, তুমি-ই সব কিছু জানো। বাদশাহ কোনো রকমে আমার ধর্ম সম্বন্ধে জ্ঞাত হইয়া গেলেন এবং আমাকে প্রাণে বধ করিবার ইচ্ছা করিলেন। আমি অনেক চেষ্টা করিয়াছিলাম যে, আমার নিজের ধর্ম বাদশাহর নিকট গুপ্ত রাখিয়া এবং প্রকাশ্যে বাদশাহর ধর্ম মানিয়া চলিব। কিন্তু, বাদশাহ আমার অন্তরের ভাব বুঝিয়া ফেলিয়াছেন। আমার মুখের কথা তাঁহার সম্মুখে বিশ্বাসযোগ্য হইল না। তিনি আমাকে বলিলেন, তোমার মুখের কথায় আমার অন্তরে এমনভাবে কাঁটা বিদ্ধ হয়, যেমন ধরিয়া লও, রুটির মধ্যে এমনভাবে কাঁটা ভরিয়া দেওয়া যাহা দেখা যায় না। কিন্তু যে রুটি খায় যদিও সে কাঁটা দেখিতে পায় না, চিবানোর সময় কাঁটা অনুভব করিতে পারে। এই রকম ভাবে তোমার মুখের কথায় মিথ্যা মিশ্রিত। আামার অন্তরে সর্বদা সন্দেহ বাড়িয়া চলিয়াছে, আমার অন্তর দিয়া তোমার মনের অবস্থা ধরিয়া ফেলিয়াছি। সেই দিন হইতেই তোমার প্রকৃত অবস্থা বুঝিতে পারিয়াছি। আমার জ্ঞান দ্বারা তোমার গুপ্ত ধারণাসমূহ বুঝিতে পারিয়াছি। এইভাবে নাসারাদের নিকট ঘটনা পেশ করিব।
গার নাবুদে জানে ঈছা চারাহাম,
উ জহুদানা ব করদে পারাহাম।
বহরে ঈছা জানে ছোপারাম ছার দেহাম,
ছদ হাজারানে মান্নাতাশ বর খোদ নেহাম।
জানে দেরেগাম নিস্ত আজ ঈছা ওয়ালেকে,
ওয়াকেফাম বর ইল্মে দীনাশ নেকে নেক।
হায়ফে মী আইঁয়াদ মরাকা ইঁ দীনে পাক,
দরমীয়ানে জাহেলানে গরদাদ হালাক।
শোকের ইজ্দেরা ও ঈছারা কে মা,
গাস্তায়েম ইঁ দীনে হক্কেরা রাহনুমা।
আজ জহুদাঁ ওয়াজ জহুদী রাস্তায়েম,
তা ব-জুন্নারে মীয়ানে রা বস্তায়েম।
দাওরে দাওরে ঈছা আস্ত আয় মরদে মাঁন,
বেশনুবীদ আছরারে কীশে উ বজাঁন,
কা ই শাহ্ বে দীনে জালেশ বছ আদুয়াস্ত,
মী নাদানাদ হীচ দুশমনরা জে দোস্ত।
ইঁ নোছকে মী গোফ্ত বা নাছরানিয়াঁ,
লেকে বুদাশ দেল বছুয়ে শাহ কাশী।
লেকে বুদাশ দেল বছুয়ে শাহ কাশাঁ।
গোফ্তে শাহ্রা কা আয় শাহানশাহ্ ছবর কুন,
তা মান ইশাঁরা কুনাম আজ বীখেও বন।
অর্থ: উজির আরো বলিল, আমি নাসারাদের মধ্যে এই কথা বলিব যে, যদি ঈসা (আ:)-এর পবিত্র রূহ আমার সাহায্যকারী না হইত, তবে ঐ বাদশাহ্ আমাকে টুকরা টুকরা করিয়া ফেলিতেন। আমি তো ঈসা (আ:)-এর জন্য আমার গর্দান ও প্রাণ দিতে প্রস্তুত। বরং ঈসা (আ:)-এর জন্য প্রাণ দিতে পারিলেই আমি নিজেকে ধন্য মনে করিব। কারণ, মনে করিব যে, আমার জান আল্লাহতায়ালা কবুল করিয়া নিয়াছেন। প্রাণ বাঁচাইবার জন্য আমার ধর্ম গোপন করি নাই। হজরত ঈসা (আঃ)-এর জন্য আমার জান মান্নত করিতে কোনো প্রকার আফসোস নাই। কিন্তু কথা হইল এই, আমি আপনাদের ধর্ম সম্বন্ধে খুব জ্ঞান রাখি। আমার শুধু এতটুকু দুঃখ হয় যে, এই পবিত্র ধর্ম এরূপ অজ্ঞ জাহেলদের দরুণ নষ্ট হইয়া যাইতেছে। কেহ জানিতেও পারিল না যে, আমার প্রাণ ধ্বংস হইয়া গেল। খোদাতায়ালার এবং হজরত ঈসা (আ:)-এর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতেছি যে, আমি এই ধর্মের একজন পথপ্রদর্শক হইয়াছি এবং ইহুদীদের মধ্য হইতে মুক্তি পাইয়াছি ও ঈসায়ী ধর্ম্মের চিহ্নশুল গলায় বাঁধিয়া ঝুলাইতে পারিয়াছি। এই যুগ হজরত ঈসা (আ:)-এর ধর্মের যুগ। ইহার কথা তোমাদের মনোযোগ দিয়া শোনা উচিত। এই পাপী অত্যাচারী বাদশাহ্ ঈসায়ী ধর্মের পরম শত্রু। শত্রু ও মিত্রের কোনো পার্থক্য করিতে পারেনা – মহাপাপী ও বে-তমীজ। এই কথা বাদশাহর সম্মুখে নাসারার দিক দিয়া বলিতেছিল। সে নিজে বাদশাহ্র লোক ছিল এবং বাদশাহ্র ধর্মেই দীক্ষিত ছিল। অবশেষে উজির বলিল, আপনি একটু অপেক্ষা করুন, দেখিবেন যে নাসারাদিগকে সমূলে ধ্বংস করিয়া দিব।
নাসারাদের উজিরের ধোকায় পতিত হওয়া
চুঁ উজির ইঁ মকর রা বর শাহ্ শুমারাদ,
আজ দেলাশ আন্দেশাহ্ রা কুল্লি ছাতারাদ।
করদে বা উয়ে শাহ্ আঁকারেকে গোফ্ত,
খলকে হয়রান মানাদ্ জা আঁ রাজে নেহুফ্ত।
করদে রেছ ওয়ারেশ মীয়ানে আঞ্জুমান,
তাকে ওয়াকেফ শোদ ব হালাশ মরদ ও জন।
রানাদ উরা জানেবে নাছ রানিয়াঁ,
করদে দর দাওয়াতে শুরু উ বাদে আজাঁ।
হালে আলম ইঁ চুনিস্ত আয় পেছার,
আজ হাছাদ মী খিজাদ ইঁহা ছার ব ছার।
অর্থ: যখন উজিরের ধোকা দেওয়ার বর্ণনা বাদশাহ্র সম্মুখে পেশ করা শেষ হইল, তখন বাদশাহ্র মনের যাবতীয় সন্দেহ দূর হইল এবং উজিরের প্রতি উহাই করা হইল, যেরূপ সে করিতে বলিয়াছিল। সর্বসাধারণের সম্মুখে উজিরকে এমন শাস্তি দেওয়া হইয়াছিল যে, সকলে দুঃখিত হইয়া পড়িয়াছিল। তারপর উজিরকে নাসারাদের বস্তির দিকে তাড়াইয়া দেওয়া হইয়াছিল। সেখানে থাকিয়া উক্ত উজির নাসারাদের মধ্যে প্রচার আরম্ভ করিয়া দিয়াছিল। যেভাবে সে পূর্বে প্রস্তাব দিয়া রাখিয়াছিল।
মাওলানা পাঠকবৃন্দকে বলিতেছেন, তোমাদের সাবধান হওয়া উচিত। দুনিয়ার অবস্থা এইরূপ হইয়া থাকে। হিংসার বশবর্তী মানুষ নানা প্রকারের ধোকা দিতে আরম্ভ করে; যদিও সে নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তথাপি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করে না।
ছদ হাজারাণে মরদে তরছা ছুয়ে উ,
আন্দেক আন্দেক জামা শোদ দরকোয়ে উ।
উ বয়ানে মী করদ বা ইশাঁ বরাজ,
ছারান আংগুলি উন ও জুন্নারো ও নামাজ।
উ বায়ান মী করদা বা ইশাঁ ফছীহ্,
দায়েমান জে আফয়ালে ও আকওয়ালে মছীহ্।
চুঁ চুনা দীদান্দ তরছায়ানাশ জার
মী শোদান্দ আন্দর গমে উ ইশকেবার।
উ বজাহের ওয়াজে আহকামে বুদ,
লেকে দর বাতেনে ছফীর দামে বুদ।
অর্থ: লক্ষ লক্ষ নাসারানী অল্প অল্প করিয়া উজিরের নিকট জমা হইল। উজির তাহাদিগকে চুপে চুপে ইঞ্জিল কেতাব, তসবীহ-তাহলীল ও নামাজের রহস্য প্রাঞ্জল ভাষায় বুঝাইতে লাগিল। সর্বদা ঈসা (আ:)-এর উপদেশাবলী ও কার্যকলাপ সম্বন্ধে আলোচনা করিত। নাসারাগণ যখন দেখিল যে, বাদশাহ উজিরের হাত, নাক ও কান কাটিয়া বেচারাকে মর্মান্তিক শাস্তি প্রদান করিয়াছেন; ইহাতে তাহারা অত্যন্ত অনুতপ্ত হইল। কিন্তু এ পাপিষ্ঠ প্রকাশ্যে নসীহতকারী ছিল, আর অন্তরে প্রকৃতপক্ষে ধোকাবাজ ও মক্করবাজ ছিল। যেমন, শিকারী বনে ফাঁদ পাতিয়া পাখীর ডাক ডাকে এবং পাখী নিজ জাতির ডাক শুনিয়া শীঘ্র করিয়া নামিয়া আসিয়া ফাঁদে আবদ্ধ হইয়া যায়।
বহরে ইঁ বাজে ছাহাবা আজ রছুল,
মুলতাবেছ বুদান্দ মক্রে নফছে গাউল।
কুচাহ আমীজাদ জে আগরাজে নেহাঁ,
দর ইবাদাতে হাউ দর ইখলাছে জাঁ।
ফজলে তায়াতে রা না জুছতান্দী আজু।
আয়বে বাতেন রা বজুছতান্দে কেনো।
মাও বমাও জররাহ্ জররা ম্করে নফছ,
মী শেনাছীদান্দ চুঁ গোল আজ ফারকাছ।
গোফ্তে জাআঁ ফছলে হুজাইফা বা হাছান,
তা বদাঁ শোদ ওয়াজ ও তাজকীরাশ হাছান।
মুশেগা ফানে ছাহাবা জুমলা শান,
খীরাহ্ গাস্তান্দে দরাঁ ওয়াজে ও বয়ান।
অর্থ: যেহেতু কোনো কোনো সময় শত্রুর ফেরেব ও ধোকাবাজী অনুভব করা যায় না। যেমন, নাসারাগণ উক্ত উজিরের ফেরেব সম্বন্ধে জ্ঞাত হইতে পারে নাই। এই রকমভাবে আমাদের নফ্সও আমাদের শত্রু। আমাদিগকে ধোকা দিবার সম্ভাবনা আছে। হয়ত কোনো সময়ে নফ্সের শত্রুতা আমরা বুঝিতে পারিব না, পথভ্রষ্ট হইয়া যাইব; এইজন্য কোনো কোনো সাহারায়ে কেরাম (রা:) হুজুর (দঃ)-এর কাছে নফ্সের ধোকা সম্বন্ধে অনুসন্ধান করিতেন যে, আমাদের ইবাদত এবং সততার মধ্যে কী কী স্বার্থপরতা থাকিতে পারে? যেমন হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, হজরত হুজাইফা ইবনে ইয়ামান (রা:) বলিয়াছেন, প্রত্যেকেই হুজুর (দ:)-এর নিকট নেক কাজের অনুসন্ধান করিতেন। আমি বদ কাজ সম্বন্ধে জানিতে চেষ্টা করিতাম। কেননা, তাহা হইলে আমি উহা হইতে বিরত থাকিতে পারিব। ইবাদতের ফজিলত সম্বন্ধে তত আগ্রহ করিয়া জানিতে চাহিতাম না। নফ্সের খারাবি সম্বন্ধে হুজুরের নিকট জিজ্ঞাসা করিয়া এমনভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে জ্ঞাত হইয়াছিলাম যে, যেমন ফুলের প্রত্যেক পাঁপড়িকে পৃথক পৃথক করিয়া জানিয়া লওয়া। নফ্সের খারাবী সম্বন্ধে কিছু বিদ্যা হজরত হাসান বসরী (রা:)-এর কাছে বর্ণনা হইয়াছে। তাহাতেই তাঁহার শিক্ষা অতি সুন্দর হইয়াছে। সাহাবাগণ (রা:) প্রত্যেকেই তাহা পছন্দ করিয়াছেন।
নাসারাদের ইহুদী উজিরের অনুসরণ করা
দেল বদু দাদান্দ তর ছায়ানে তামাম,
খোদ চে বাশাদ কুয়াতে তাকলিদে আম।
দরুদরুনে ছীনা মহ্রাশ কাশতান্দ্,
নায়েবে ঈছাইয়াশ মী পেন্দাশতান্দ।
উ বছেরে দজ্জাল এক চশমেল আইন,
আয়ে খোদা ফরইয়াদ রছ নেয়ামালমুঈন।
অর্থ: সকল নাসারা উক্ত উজিরের অনুসরণকারী হইয়া গেল। প্রকৃতপক্ষে, অজ্ঞ লোকের অনুসরণের কোনো স্থায়িত্ব নাই। না বুঝিয়া শুনিয়া শুধু মনের খেয়াল মোতাবেক যাহার সহিত ইচ্ছা করে তাহার সাথেই মত দেয়। নিজেদের অন্তরে উজীরের মহব্বতের দানা বপণ করিয়া লইয়াছে এবং তাহাকে হজরত ঈসা (আ:)-এর প্রতিনিধি মনে করিতে লাগিল।
প্রকৃতপক্ষে, সে একজন অভিশপ্ত দাজ্জাল ছিল। অর্থাৎ, ঈসা (আ:)-এর বিরুদ্ধে ছিল, দাজ্জালের ন্যায় পথভ্রষ্টকারী ছিল। এইরূপভাবে, আমরাও নফ্স ও মানব রূপধারী শয়তানের ধোকায় পতিত হই। এই জন্য মাওলানা দুঃখিত হইয়া আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করিতেছেন, হে খোদা! আমাদিগকে সাহায্য করিও, তুমি-ই প্রকৃত সাহায্যকারী।
ছদ হাজারানে দামো ও দানাস্ত আয়ে খোদা,
মা চু মোরগানে হারীছ বে নাওয়া।
দম বদম পা বস্তাহ দামে তু আয়েম,
হরিয়েকে গার বাজু ছীমোরগী শওয়েম।
মী রাহানে হরদমে মারা উ বাজ,
ছুয়ে দামে মী রওয়েম আয়বে নাইয়াজ।
অর্থ: মাওলানার শেষ মোনাজাত। তিনি বলিতেছেন, হে খোদা! হাজার হাজার ও লক্ষ লক্ষ শিকারীর জাল-ফাঁদ বিছান আছে ও লক্ষ লক্ষ দানা ছড়ান আছে, আর আমরা মানুষ, আমাদের অবস্থা লোভী পাখীর ন্যায় – একেক সময় একেক নতুন ফাঁদে আবদ্ধ হইয়া যাই। আমরা বাজ পাখী বা উট পাখী-ই হইনা কেন, তোমার দয়ায় সব সময় ঐ জাল বা ফাঁদ হইতে বাহির করিয়া রাখ। কিন্তু আমরা আবার অন্য ফাঁদের দিকে অগ্রসর হইতে থাকি। অর্থাৎ, আমরা নফ্স ও শয়তানের রকমারী ধোকায় পতিত হইতে থাকি।
মা দরী আমবারে গুন্দাম মী কুনেম,
গন্দাম জমায়া আমদাহ গম মী কুনাম।
মী নাইয়ান্দাশেম মা জমেয় উহুশ,
কে ইঁ খলল দর গুন্দাম আস্ত আজ মকরে মূশ।
মূশ তা আমবারে মা হোফরাহ্ জাদাস্ত,
ও আজ ফনাশ্ আমবারে মা খালী শোদাস্ত।
অর্থ: মাওলানা বলেন, আমাদের দৃষ্টান্ত এইরূপ যে, আমরা গন্দমের স্তুপ জমা করি, কিন্তু উহা আমরা পাইনা; জানোয়ারের ন্যায় আমাদের বুদ্ধি নাই যে আমাদের এই ক্ষতি ফেরেববাজ ইঁদুরের দ্বারা সাধিত হইয়াছে। ইঁদুরে গন্দমের স্তুপ পর্যন্ত গর্ত করিয়া লইয়াছে। ইহারা সমস্ত গন্দম খালি করিয়া লইয়াছে।
এই রকমভাবে আমরা রনক কাজ করিতে থাকি, কিন্তু উহার বরকত ও ক্রিয়া কোনো কিছুরই নাম-নিশানা দেখিতে পাই না। কারণ, নফ্স ও ধোকাবাজ শয়তানের ধোকায় পড়িয়া স্বার্থপর ব্যাধির সাগরে সব ধোওয়াইয়া নিয়া যায়।
আউয়াল আয় জানে দাফে শররে মূশে কুন,
ওয়া আঁ গাহাঁ দর জমে গন্দামে জুশে কুন।
বেশনু আজ আখ্বারে আঁ ছদরে ছদুর,
লা ছালাতা তাম্মা বিল হুজুর।
গার না মূশে দোজদে দর আম্বারে মাস্ত,
গন্দামে আমালে চালছালাহ্ কুজাস্ত।
রীজাহ্ রীজাহ্ ছেদকে হররোজে চেরা,
জামায়া মী না আইয়াদ দরী আমবারে মা।
অর্থ: মাওলানা বলেন, সর্বপ্রথম নফ্স ও শয়তানের ধোকা হইতে নিজেকে বাঁচাও। তারপর রিয়া ব্যতীত খাঁটি নিয়তে নেক আমল করিতে থাক। আস্তে আস্তে নেক আমল জমা হইতে থাকিবে এবং উহা আল্লাহর নিকট কবুল হইবে। ইহার প্রমাণস্বরূপ মাওলানা হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়া বলিতেছেন, হুজুর (দঃ) ফরমাইয়াছেন: একাগ্রচিত্ত ছাড়া নামাজ কখনও আল্লাহর দরবারে কবুল হয়না। নফ্সের স্বার্থপরতা ও শয়তানি ধোকা আত্মা হইতে দূর করিতে হইবে। না হইলে কোনো নেক কাজ আল্লাহ্র নিকট গ্রহণীয় হইবে না। যদি আমাদের নেক আমলের স্তুপের মধ্যে নফ্স ও শয়তান নামক ইঁদুর না থাকিত, তবে আমাদের নেক আমলের ক্রিয়া ও বরকত কোথায় গেল? ইহার ক্রিয়া মহব্বতে ইলাহী এবং দুনিয়াকে খারাপ জানা, এইরূপ ক্রিয়া, আমাদের অন্তরে সৃষ্টি হইল না কেন। যদি প্রত্যহ একটু একটু করিয়া নেক আমল জমা হইত, তবে এক স্তুপে পরিণত হইত।
বছে ছেতারাহ্ আতেশ আজ আহান জাহীদ,
ও আঁ দেল ছুজীদাহ্ পীজ রফ্ত ও কাশীদ।
লেকে দর জুলমাত একে দুজদে নেহাঁ,
মী নেহাদ আংগাস্তে বর ইস্তারে গাঁ।
মী কোশাদ ইস্তারে গাঁরা এক ব এক,
তাকে না ফেরুজাদ চেরাগে বর ফালাক।
অর্থ: মাওলানা বলেন, মানুষ নিজের হাত, পা ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা অনেক প্রকার নেক আমল করে। ইহা দ্বারা অন্তরেও কিছু আলো প্রতিফলিত হয়। কিন্তু, অজ্ঞতার অন্ধকারে কু-রিপুগুলি ও শয়তান গুপ্ত শত্রু চোরস্বরূপ অন্তরে নিহিত আছে। উহারা নেক আমলগুলি সমস্ত মুছিয়া ফেলে। যাহাতে নেক আমলের ক্রিয়া অন্তরে স্থায়ীভাবে না থাকিতে পারে, সেজন্য সর্বদা চেষ্টা করিতে থাকে। যেমন, কাহারও ঘরে অন্ধকারে যদি কোনো চোর ঢোকে আর ঘরের মালিক টের পাইয়া উঠিয়া এক টুকরা কয়লার আগুন লইয়া শুকনা ছোবরা অথবা তুলা নিয়া ঐ অগ্নিখণ্ডের নিচে রাখিয়া ফুৎকার দিয়া জ্বালাইতে চেষ্টা করে, যে আলোতে চোরকে স্বচক্ষে দেখিবে। এমন সময় চোর অন্ধকারের মধ্যে চুপ করিয়া আসিয়া মালিকের নিকট বসিয়া ফুৎকারের সাথে যে অগ্নিকণাগুলি নির্গত হয়, তাহা হাত দিয়া আস্তে নিভাইয়া দেয়। যাহাতে মালিক অগ্নিকণার আলোতে চোরকে এবং তাহার মালামাল দেখিতে না পায়। এই রূপভাবে মানুষের অন্তঃকরণের মধ্যে কু-রিপুগুলি ও শয়তানি দাগাবাজী গুপ্তভাবে আছে। তাহারা লোকের নেক আমলগুলি হাত দিয়া চাপিয়া মুছিয়া ফেলে, যাহাতে নেক আমলের কোনো ক্রিয়া অন্তরে প্রতিফলিত না হইতে পারে এবং নেক আমলগুলি আল্লাহর দরবারে স্বীকৃতি লাভ করিতে না পারে, সেজন্য তাহারা সর্বতোভাবে চেষ্টা করিতে থাকে। এই অজ্ঞতার অন্ধকার সম্বন্ধে আমরা জ্ঞাত নহি।
চুঁ এনায়েতাত বুদ বা মা মুকিম,
কায়ে বুয়াদ বীমে আজাঁ দুজ্দে লাইম।
গার হাজারানে দামে বাশদ দর কদম,
চুঁ তু বা মাই না বাশদ হীচে গম।
অর্থ: এখানে মাওলানা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করিতেছেন যে, যদিও কু-রিপর তাড়না ও শয়তানের ধোকা অত্যন্ত বিপজ্জনক, তথাপি তুমি যদি তোমার রহমত আমাদের উপর সর্বদা বর্ষণ করিতে থাক, তবে আমাদের ঐ শত্রু হইতে কোনো ভয়ের কারণ নাই। যদি আমাদের প্রত্যেক পায়ে হাজারো ফাঁদের জাল বিছানো থাকে এবং তুমি যদি আমাদের সাথে থাক; তবে কোনো ভয়ের কারণ নাই। উপরোক্ত বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায় যে, বান্দার নিজের মারেফাত ও মোজাহেদার উপর ভরসা করা চলিবে না। খোদার রহমতের উপর ভরসা রাখিতে হইবে।
হরশবে আজ দামে তন আরওয়াহ্ রা,
মী রেহানী মী কুনী আল ওয়াহ্রা।
মী রেহান্দ আরওয়াহ্ হর শবে জীইঁ কাফাছ,
ফারেগানে নায়ে হাকেম ও মাহকম কাছ।
শবে জে জেন্দানে বে খবর জেন্দানিয়াঁ,
শবে জে দৌলাত বে খবর ছুলতানিয়াঁ।
নায়েগমে ও আন্দেশায়ে ছুদ ও জিয়া,
নায়ে খেয়ালেইঁ ফুলান ও আঁ ফুলা।
অর্থ: মাওলানা বলেন, হে খোদা, তুমি যদি চাও, তবে আমাদিগকে শয়তানি খেয়াল ও কু-রিপুর তাড়না হইতে বিরত রাখিতে পারো। যেমন, প্রত্যহ রাত্রিতে আমাদের রূহকে পিঞ্জিরাস্বরূপ দেহ হইতে মুক্ত করিয়া দাও। আমাদের রূহসমূহ দেহের মধ্যে আবদ্ধ থাকে। প্রত্যেক দিন-রাত্রে কয়েদখানাস্বরূপ দেহ হইতে রূহগুলিকে মুক্ত করিয়া দাও। তাহারা নিশ্চিন্তে সর্বত্র ভ্রমণ করিয়া বেড়ায়। তাহাদের কোনো হাকেম বা মাহ্কুম থাকে না। কয়েদিদের কয়েদখানার কথা মনে থাকে না। বাদশাহদের ধন-দৌলাত ও রাজত্বের কথা খেয়াল থাকে না। কাহারো লাভ-লোকসানের খেয়াল থাকে না, কোনো আত্মীয়-এগানার কথা মনে পড়ে না; সেইরূপভাবে আমাদিগকে অভ্যন্তরীণ চিন্তা হইতে মুক্ত করিয়া দিলে তোমার কোনো ক্ষতি হয় না। তোমার পক্ষে আমাদিগকে আমাদের অভ্যন্তরীণ শত্রুর বিপদ হইতে মুক্ত করিয়া দেওয়া মোটেই কঠিন কাজ নয়।
আরেফের অবস্থার দৃষ্টান্ত ও পবিত্র কুরআনের আয়াতের অর্থ
আল্লাহু ইয়াতাওয়াক্কাল আন্ফুছুহীনা মাওতেহা ওয়াল্লাতী লাম তামুত ফী মানামেহা।
হালে আরেফ ইঁ বুদ ব খাবে হাম,
গোফ্তে ইজদে হাম রুকুদুন জী মরদাম।
খোফ্তাহ আজ আহ্ওয়ালে দুনিয়া রোজও শব,
চুঁ কলম দর পাঞ্জায়ে নকলীবে রব।
আঁকে উ পাঞ্জা না বীনাদ দর রকম,
ফেলে পেন্দারাদ বা জাম্বাশ আজ কলম।
অর্থ: মাওলানা আরেফ ও কামেল লোকের অবস্থা বর্ণনা করিয়া বলিতেছেন, অন্যান্য লোক যেমন নিদ্রিত অবস্থায় দেহ হইতে মন বিচ্ছিন্ন হইয়া যায়, তেমনিভাবে খাঁটি কামেল লোকের জাগ্রত অবস্থায়ও দেহ হইতে মন বিচ্ছিন্ন থাকে। অর্থাৎ, ইহ-জাগতিক যে সমস্ত বস্তু আল্লাহর মহব্বত হইতে বিরত রাখে, সে সমস্ত বস্তুর প্রতি কামেল লোকের খেয়াল থাকে না। যে সমস্ত কাজ অথবা কথাবার্তা আল্লাহ হইতে দূরে সরাইয়া রাখে, সেদিকে তাঁহাদের মোটেই খেয়াল থাকে না। ঐ সমস্ত কাজ হইতে আরেফ-ব্যক্তি সর্বদা বিরত থাকেন। যেমন, আল্লাহ্তায়ালা আসহাবে কাহাফ সম্বন্ধে বলিয়াছেন, তোমরা তাহাদিগকে চক্ষু খোলা অবস্থায় দেখিয়া জাগ্রত মনে করিও না। প্রকৃতপক্ষে তাঁহারা নিদ্রিত অবস্থায় আছেন। অর্থাৎ, জাগ্রত অবস্থায় থাকিলেও তাঁহারা দুনিয়ার হাল-হকিকত হইতে অজ্ঞাত রহিয়াছেন। সেইরূপভাবে, আরেফ লোক জাগ্রত থাকিয়াও দুনিয়ার অবৈধ কাজ হইতে বিরত রহিয়াছেন। তাঁহারা দিবা-রাত্রি দুনিয়ার অবৈধ কার্যসমূহ হইতে নিদ্রিত আছেন। আরেফ লোক আল্লাহ্র এমন বাধ্যগত, যেমন লেখকের হাতে কলম বাধ্যগত থাকে। লেখক যেভাবে ইচ্ছা করে, সেই ভাবে ঘুরাইতে ফিরাইতে পারে। কলমকেও সেইভাবে ঘুরিতে ফিরিতে হয়। আরেফ লোকও আল্লাহর মর্জি মাফিক চলাফিরা করেন। আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ-কর্ম সমাধা করেন। আর যাহারা কলমের হাতকে না দেখে, তাহারা মনে করে যে, কলম নিজেই নড়াচড়া করিয়া লিখে। তাই তাহারা প্রত্যেক কাজকে নিজের ইচ্ছাধীন মনে করিয়া যাহা ইচ্ছা তাহাই করিতে পারে। খোদার আদেশ-নিষেধের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করে না। খোদার আদেশ-নিষেধ অমান্য করিয়া যাহা ইচ্ছা তাহাই করিতে অভ্যস্ত হয়। খোদার খুশী ও না-খুশীর প্রতি লক্ষ্য রাখে না। এই প্রকারের লোকই গণ্ড-মূর্খ ও গোমরাহ্ বলিয়া পরিচিত।
শাম্মা জী ইঁ হালে আরেফ ওয়া নামুদ,
খালকে রা হাম খাবে হেচ্ছি দররে বুদ।
অর্থ: আল্লাহতায়ালা দয়াপরবশ হইয়া সর্বসাধারণকে আরেফীনদের ন্যায় আল্লাহর মহব্বতে মশগুল হইবার জন্য নিদ্রিত অবস্থায় স্বপ্ন দেখার শক্তি প্রদান করিয়াছেন। স্বপ্ন দেখিয়া আল্লাহর ধ্যানে মশগুল হইবার চেষ্টা করিবে।
রফতাহ্ দর ছাহ্রায়ে বেচু জানে শাঁ,
রূহে শাঁ আছুদাহ্ ওয়া আবদানে শাঁ।
ফারেগানে আজ হেরছে ও আকবারে ও হাছাছ,
মোরগে ওয়ার আজ দামে জুস্তা আজ কাফাছ।
অর্থ: স্বপ্নে লোকের রূহ্ অবর্ণনীয় ময়দানে চলিয়া যায়। ইহাতে দেহ ও মন উভয়ই তৃপ্তি লাভ করে। লোভ ও লালসা এবং নিজের প্রাপ্য ও চাহিদা হইতে মুক্ত হইয়া যায়। যেমন ফাঁদে বা পিঞ্জিরাবদ্ধ পাখী মুক্তি পায়। সেই রকম স্বপ্নে মানুষের রূহ দেহ হইতে মুক্তি পায়। ইহা দ্বারা বুঝিতে হইবে যে, জাগ্রত অবস্থায়ও পার্থিব বস্তুর লোভ-লালসা ত্যাগ করিয়া মনকে সুস্থ রাখিতে হইবে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টিতে নিজের মনকে সন্তুষ্ট রাখিতে হইবে। তবেই আরেফের অবস্থা অনুধাবন করিতে সক্ষম হইবে।
চুঁ বছুয়ে দামে বাজ আন্দর শওয়ান্দ,
দাদে জুইয়ানে দরপায়ে দাওর শওয়ান্দ।
ওয়াজ ছফীরে বাজ দামে আন্দর কাশী,
জুমলারা দর দাদে ও দর দাওরে কাশী।
চুঁকে নূরে ছোবহা দম ছার বর জানাদ,
কার গাছে জররীন গেরদুনে পর জানাদ।
তরকে রোজে আখির চুবা জরীন ছাপার,
হিন্দুবী শবেরা বে তেগ আফগান্দাহ্ ছার।
মায়েলে হর জানে বছুয়ে তন শওয়াদ,
হর তনে আজ রূহে আ বস্তান শওয়াদ।
ফালেকুল ইছ্বাহ্ ইস্রাফীল ওয়ার,
জুমলারা দরছরাতে আরাদ জানে দিয়ার।
রূহায়ে মোমবাছাত রা তন কুনাদ,
হর তনে রা বাজ আ বস্তান কুনাদ।
অর্থ: এখানে মানুষের নিদ্রা ভঙ্গ হওয়ার পর রূহ্ দেহের মধ্যে প্রবেশ করে, অর্থাৎ নিদ্রা হইতে জাগ্রত হওয়ার পর মানুষের যে অবস্থা হয়, তাহার বর্ণনা দিতেছেন। মাওলানা বলেন, যখন রূহ্ মানবদেহে আসিয়া পুনঃআবদ্ধ হয়, তখন ইহ-জাগতিক কাজে লিপ্ত হইয়া যায়। যেমন, নিজের বিচারের রায় প্রাপ্তির জন্য হাকীমের পিছে পিছে ঘুরিতে থাকে। আল্লাহর হুকুমে রূহ্কে ফাঁদস্বরূপ দেহের মধ্যে আবদ্ধ করিয়া লয়। যেমন শিকারী নিজের পোষা পাখী দ্বারা বনের পাখী খাঁচায় আবদ্ধ করিয়া লয় এবং প্রত্যেককে নিজেদের বিচারের ফলাফল ভোগ করার জন্য নিজ নিজ কাজে লাগাইয়া দেয়। যখন ভোরে সূর্য উদিত হয়, রাত্রির অন্ধকার বিদূরিত হয়, সূর্য পূর্ণ আলোক বিস্তার করে, তখন রূহ দেহের মধ্যে আসিয়া পড়ে এবং প্রত্যেক দেহ রূহ্ দ্বারা এমনভাবে পরিপূর্ণ হইয়া যায়, যেমন গর্ভবতী মেয়েলোকের পেট সন্তান দ্বারা ভরিয়া যায়।
আল্লাহতায়ালা সমস্ত মাখলুকাতকে নিজ নিজ দেহে রূহ প্রত্যাবর্তন করাইয়া দেহগুলিকে পুনঃজীবিত করিয়া দেন।
আছপে জান রা মী কুনান আরী জে জীন,
ছাররেন নাওমু আখুল মওয়াতাস্ত ইঁ।
লেকে বহ্রে আঁকে রোজে আইয়ান্দ বাজ,
বর নেহাদ বর পায়ে শাঁ বন্দে দরাজ।
তাকে রোজশ ওয়া কাশাদ জাঁ মর গাজার,
দরচেরাগাহ্ আরাদাশ দর জীরে বার।
অর্থ: এখানে দ্বিতীয়বার নিদ্রা যাইবার কথা বর্ণনা করা হইয়াছে। অর্থাৎ, আল্লাহতায়ালা রূহ্কে ফের ইহ-জগতের সম্বন্ধ হইতে ফিরাইয়া লন এবং হাদীছের বর্ণনা অনুযায়ী ঘুম যে মৃত্যুর ভাই, উহা আসিয়া রূহ্কে ঘিরিয়া ধরে। ইহ-জাগতিক চিন্তা হইতে মুক্ত হইয়া যায়, কিন্তু রূহের পায়ে এক গাছি রশি বাঁধিয়া দেওয়া হয়, যেন সে ফিরিয়া আসিতে পারে। যেমন ঘোড়া মাঠে চড়িতে দিবার সময়ে পায়ে রশি বাঁধিয়া দেওয়া হয়; কারণ যখন ইচ্ছা টানিয়া আনা যায় এবং সময় মত কাজও করান যায়। অর্থাৎ, রূহকে ফিরাইয়া আনা, হায়াত পর্যন্ত দুনিয়ার বোঝা বহন করিবার জন্য।
কাশ চুঁ আাছহাবে কাহাব আঁ রূহ রা,
হেফ্জে করদে ইয়া চু কাস্তে নূহরা।
তা আজি তুফানে বিদারী ও হুশ,
ওয়া রাহীদে ইঁ জমীরো চশমো গোশ।
অর্থ: এখানে আরেফের আকাঙ্ক্ষার কথা বর্ণনা করা হইয়াছে। আরেফ বলেন, যদি আল্লাহতায়ালা আমাদিগকে আসহাবে কাহাফের মত আবদ্ধ করিয়া রাখিতেন, তবে অত্যন্ত ভাল হইত। কারণ, আমরা দুনিয়ার খেয়াল হইতে বিরত থাকিতাম, অথবা নূহ (আঃ)-এর কিশতির ন্যায় আমাদিগকে উহাতে উঠাইয়া রাখা হইত, তবে আমরা দুনিয়ার মুসিবত হইতে রক্ষা পাইতাম। অর্থাৎ, আমাদের নিদ্রা যদি অনেক বৎসর ধরিয়া স্থায়ী থাকিত, তবে আমরা এই দুনিয়ার অস্থায়ী বস্তুর মহব্বত যাহা নূহ (আ:)-এর সময়ের তুফানের ন্যায় বিপদজনক, উহা হইতে মুক্তি পাইতাম। পার্থিব বস্তুর মহব্বতে আমরা আবদ্ধ হইতাম না। সর্বদা আল্লাহর মহব্বতে মশগুল থাকিতাম। সালেক যখন আল্লাহর মহব্বতে ডুবিয়া থাকে, তখন উক্তরূপ আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করিয়া থাকেন। যখন দুনিয়ার অবস্থা সম্বন্ধে জাগ্রত থাকেন, তখন মোজাহেদা করিয়া অন্তরকে আল্লাহর দিকে ধাবিত রাখিতে হয়।
আয় বছা আছহাবে কাহাব আন্দর জাহ্যাঁ,
পহ্লেবে তু পেশে তু হাস্ত ইঁ জমাঁ।
গারে বাতু ইয়ারে বাতু দর ছরুদ,
মহ্রে বর চশমাস্ত ও বর গোশাত চে ছুদ।
বাজে গো কাজো চিস্ত ইঁ রু পোশে হা।
খত্মে হক্ বর চশমোহাউ গোশেহা।
অর্থ: এখানে বর্ণনা করা হইয়াছে যে, সাধারণ লোকেরা নিদ্রিত অবস্থায় যেমন দুনিয়ার অবস্থা হইতে বেখবর হইয়া যায়, সেই রকমভাবে আরেফ লোক জাগ্রত অবস্থায় দুনিয়ার হালত হইতে সর্বদা বে-খবর থাকেন। তাই মাওলানা বলেন যে, আসহাবে কাহাফের ন্যায় বহু আরেফ লোক এই দুনিয়ায় জীবিত আছেন। তোমাদের সম্মুখে তোমাদের নিকট তোমাদের বন্ধু হিসাবে তোমাদের সাথে মিলিয়া মিশিয়া আলাপ-আলোচনা করেন। কিন্তু, তোমাদের চক্ষে ও কর্ণে সীলমোহর লাগান হইয়াছে। তাঁহারা তোমাদের সম্মুখে তোমাদের সাথে থাকায় কী উপকার হইবে? মাওলানা প্রশ্ন করিতেছেন, তোমরা বল তো, তোমাদের এই আবরণ কিসের কারণে সৃষ্টি হইয়াছে যে, তোমরা আল্লাহ্র অলিকে চিন না । অতঃপর মওলানা নিজেই জওয়াব দিতেছেন, তোমাদের কর্ণে ও চক্ষে আল্লাহতায়ালা মোহর করিয়া দিয়াছেন। তারপর তিনি আবরণের বর্ণনা করিয়া নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছেন, যাহাতে ঐ আবরণ দূর করা সম্ভব হয়।
[খলিফার লায়লাকে দেখার বর্ণনা]
গোফ্তে লায়লা রা খলিফা কাঁ তুই,
কাজ তু মজনুন শোদ পেরিশাঁও গবি।
আজ দিগা খুঁবা তু আফ্জু নিস্তি,
গোফ্তে খামুশ চুঁ তু মজনুন নিস্তি।
দীদায়ে মজনুন আগার বুদে তোরা,
হর দো আলম বেখ্তর বুদে তোরা।
বাখোদী তু লেকে মজনুনবে খোদাস্ত,
দর তরীকে ইশকে বেদারী বদাস্ত।
অর্থ: খলিফা লায়লার নিকট জিজ্ঞাসা করিলেন, হে লায়লা! তুমি কি ঐ ব্যক্তি, যাহার জন্য মজনুন দুঃখিত হইয়া পাগল হইয়া গিয়াছে। অন্য সুন্দরী হইতে তুমি ত কোনো অংশে অধিক সুন্দরী নও! লায়লা উত্তর করিল, তুমি যখন মজনুন নও, চুপ থাক; যদি তোমাকে আল্লাহ্তায়ালা মজনুনের ন্যায় দুইটি চক্ষু দান করিতেন, তবে দুনিয়া ও আখেরাত তোমার নিকট মূল্যহীন হইয়া পড়িত। তোমার ও মজনুনের মধ্যে পার্থক্য শুধু এইটুকু যে, তুমি এখন পর্যন্ত হুশ অবস্থায় আছ, আর মজনূন হুশ অতিক্রম করিয়া বেহুশ হইয়া রহিয়াছে। এইজন্য তুমি আমার সৌন্দর্যের রহস্য অবুভব করিতে পারিতেছ না, এবং মজনুন আমি ব্যতিত কাহারও উপর দৃষ্টি রাখে না, এই জন্য সে আমার সৌন্দর্যের রহস্য অনুভব করিতে পারিয়াছে। ইশ্কের পথে হুশ রাখা ও জাগ্রত থাকা অবৈধ কাজ। মাওলানা এখানে উক্ত আবরণের কথা উল্লেখ করিয়া দিয়াছেন যে, উক্ত আবরণ দুনিয়ার মহব্বত ও উহার সম্বন্ধে সজাগ থাকা।
হরকে বেদারাস্ত উ দর খাবে তর,
হাস্তে বিদারিয়াশ আজ খাবাশব্দতর।
চুঁ ব হক্কে বেদার নাবুদ জানে মা,
হাস্তে বেদারিয়ে চু দর বন্দানে মা।
জানে হামা রোজ আজ লাকাদ কুবে খেয়াল,
ওয়াজ জিয়ানো ছুদো ও আজ খাওফে জওয়াল।
নায়ে ছাফাহী মান্দাশ নায়ে লুতফো ওয়াফার,
নায়ে বছুয়ে আছেমান রাহে ছফার।
অর্থ: এখানে মাওলানা দুনিয়াদারীর খেয়ালের কুফল বর্ণনা করিতেছেন, যে ব্যক্তি দুনিয়ায় বেশী বুদ্ধিমান, সেই ব্যক্তি-ই খোদাকে বেশী ভুলিয়া রহিয়াছেন। তাহার জাগ্রত অবস্থা নিদ্রিত অবস্থার চাইতে অনেক খারাপ। কেননা জাগ্রত অবস্থায় দুনিয়ার ধন সম্পদ এবং সুখ-শান্তির অন্বেষণে পাপের কাজে লিপ্ত হয়। যদি আমাদের জাগ্রত অবস্থায় আল্লাহর সাথে যোগাযোগ না হইল, তবে আমাদের জাগ্রত অবস্থা কয়েদখানায় আবদ্ধ বলিয়া পরিগণিত হয়। আল্লাহ ব্যতীত অন্য বস্তুর অন্বেষণে থাকায় আমাদের রূহ্ সদা দুঃখিত থাকে। দুনিয়ার মুনাফা, ক্ষতি ও লোকসানের চিন্তায় ও ধন সম্পদ ধ্বংস হওয়ার ভাবনায় এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় যে, অন্তরে কোনো সময়ে আল্লাহর মহব্বতের আলো এবং উহার সৌন্দর্য বিকাশ লাভ করিতে পারে না। আল্লাহর নিকট প্রত্যাবর্তন করিতেও সাহস পায় না।
খোফ্তাহ্ আঁ বাশদ কেউ আজহর খেয়াল,
দারাদ উমেদ ও কুনাদ বা উ মাকাল।
নায়ে চুনাকে আজ খেয়াল আিইয়াদ বহাল,
আঁ খেয়ালাশ গরদাদ উরা ছদ ও বাল।
দউয়ারা চুঁ হুর বীনাদ উব খাব,
পাছ্ জে শাহওয়াত রীজাদ উবা দউয়াব।
চুঁ কে তখমে নছলরা দর শুরাহ্ রীখ্ত,
উ বখেশ আমদ খেয়ালে আজ ওয়ায়ে গিরীখ্ত।
জোয়ফে ছার বীনাদ আজাঁ ওতন পলীদ,
আহ্ আজ আঁ নক্শে পেদীদ ওনা পেদীদ।
অর্থ: মাওলানা এখানে নিদ্রার প্রকার ও ভেদাভেদ বর্ণনা করিতে যাইয়া বলিতেছেন, নিদ্রার মধ্যে ঐ নিদ্রা উত্তম, যে নিদ্রার মধ্যে সব সময়ে আল্লাহর খেয়াল থাকে এবং আল্লাহর সাথে মিলন ও কথাবার্তা বলার আশা থাকে। ঐরূপ নিদ্রা ভাল নহে, যাহার মধ্যে খারাপ চিন্তা ও ভাবনার সম্ভাবনা আছে এবং প্রকৃত অবস্থায় ফিরিয়া আসিলে ঐ খেয়ালের কারণে তাহাকে শাস্তি ভোগ করিতে হয় এবং ধ্বংস হইতে হয়। অর্থাৎ, ইহ-জগতে বসিয়া সব সময়ে দুনিয়ার সুখ-শান্তির চিন্তায় মগ্ন থাকিলে যে সময়ে মৃত্যু আসিবে তখন পাপসমূহ ও ভয়ঙ্কর শাস্তি ব্যতীত আর কিছুই দেখিবে না। এই রকম নিদ্রার উদাহরণ দিয়া মাওলানা বলিতেছেন, যেমন, কোনো ব্যক্তি স্বপ্নে শয়তানকে এক সুন্দরী মেয়েলোক রূপে দেখিতে পাইল এবং কাম উত্তেজনায় তাহার সহিত সঙ্গম করিয়া বীর্যপাত করিল। তাহার বীর্য নছলের বীজ ছিল, উহা লোনা জমিনে বপণ করিল; অর্থাৎ অনুপযুক্ত জায়গায় ফেলিল। যখন স্বপ্ন ভাঙ্গিয়া গেল এবং হুশ ইহল, তখন মাথায় দুর্বলতা অনুভব করিতেছে এবং শরীর না-পাক হইয়া গিয়াছে বুঝিতে পারিল। এখন আফসোস করা ছাড়া আর কিছুই বাকী নাই। কারণ, সেই খেয়ালী সুরত দেখিতে পায় না, জাগ্রত হওয়ার কারণে উহা দূর হইয়া গিয়াছে। প্রকৃত অবস্থায় উহা কিছুই ছিল না। শুধু তাহার খেয়ালীপনা ছিল। এইরূপভাবে যাহারা ইহজীবনে আল্লাহ্ ছাড়া অন্য বস্তুর মোহগ্রস্ত আছে, মৃত্যুকালে তাহাদের দুঃখ ও আফসোস ব্যতীত কিছুই থাকিবে না।
মোরগে বর বালা পর আঁ ও ছায়াশ,
মী রওয়াদ বরখাকে পররানে মোরগোয়াশ।
আবলাহে ছাইয়াদে আঁ ছায়া শওয়াদ,
মী রওয়াদ চান্দাঁ কে বে মায়া শওয়াদ।
বে খবর কানে আক্ছে আঁ মোরগে হাওয়াস্ত,
বেখবর কে আছলে আঁ ছায়া কুজাস্ত।
তীর আন্দাজাদ বছুয়ে ছায়া উ,
তর কাশাশ খালি শওয়াদ আজ জুস্তে জু।
তরকাম ওমরাশ তিহি শোদ ওমরে রফ্ত,
আজ দওবীদানে দর শেকারে ছায়ায়ে তাফ্ত।
অর্থ: এখানে মাওলানা এই অস্থায়ী জগত ও চিরস্থায়ী আখেরাত সম্বন্ধে একটি উদাহরণ দিয়া পরিষ্কার করিয়া বুঝাইয়া দিয়াছেন, এই ক্ষণস্থায়ী পৃথিবী কখনও চিরস্থায়ী আখেরাতের সমতুল্য হইতে পারে না। অতএব, আখেরাত বাদ দিয়া দুনিয়া তলব করা যেমন কোনো পাখী আকাশে বায়ু ভরে উড়িতেছে এবং উহার ছায়া জমিনে পতিত হইয়া দৌড়াইতেছে। যদি কোনো বোকায় ঐ ছায়া দেখিয়া উক্ত ছায়া শিকার করার জন্য যতই চেষ্টা করিবে সকল চেষ্টাই ব্যর্থ হইয়া যাইবে। কিছুতেই ছায়া শিকার করিতে পারিবে না। এইরূপভাবে যে ব্যক্তি ইহ-জগতে তৃপ্তি লাভ করিতে চাহিবে, তাহার সমস্ত জীবন নষ্ট হইয়া যাইবে, কিন্তু কিছুতেই সে সন্তুষ্ট হইতে পারিবে না। শেষফল দুঃখিত ও লজ্জিত হইতে হইবে। অতএব, সকলকেই আখেরাতের কথা ভাবিয়া ইহ-জীবনে পরকালের সম্বল জোগাড় করিতে হইবে।
অলিয়ে মোরশেদের অনুসরণ করার জন্য প্রেরণা
ছায়ায়ে ইজদানে চু বাশদ দায়াআশ,
ওয়া রেহানাদ আজ খেয়ালো ছায়াশ।
ছায়ায়ে ইজদানে বুদ বান্দায়ে খোদা,
মোরদায়ে ইঁ আলম ও জেন্দাহ্ খোদা।
দামানে উ গীরিজ ও তর বেগুমান,
তারহি আজ আফাতে আখেরে জমান।
অর্থ: যখন দুনিয়ার খেয়ালাত এবং উহা হাসিল করার কুফল বর্ণনা করা হইয়াছে; এখন উহা হইতে মুক্তি পাইবার পথ প্রদর্শন করা হইতেছে। তাই মাওলানা বলেন, দুনিয়ার গোমরাহী হইতে মুক্তি পাইতে হইলে কামেল পীরের সোহ্বাত লাভ করিতে হইবে। কেননা, যদি কাহারো নেতা বা মুরব্বি আল্লাহ্র ছায়া হইয়া যায়, অর্থাৎ পীরে কামেল যদি কোনো ব্যক্তির নেতা হয়, তবে সে দুনিয়ার খেয়াল হইতে মুক্তি পায়। ঐ আল্লাহর ছায়া হইল আল্লাহর কামেল বান্দা, যিনি ইহ-জগতের খোয়াল হইতে মৃত এবং আল্লাহর ধ্যানে জীবিত। এইরূপ ব্যক্তির নিকট শীঘ্র করিয়া যাইয়া কোনো সন্দেহ না করিয়া তাঁহার উপদেশ অনুযায়ী নিজেকে গড়িয়া তুলিতে চেষ্টা করিবে। তাহা হইলে মৃত্যুর সময়ে ঈমান নিয়া চলিয়া যাইতে পারিবে। উপরে দুনিয়াকে অস্থায়ী হিসাবে ছায়ার সহিত তুলনা করা হইয়াছে। আর এখানে কামেল বান্দাকে আল্লাহর পথপ্রদর্শক হিসাবে আল্লাহর ছায়া বলা হইয়াছে। যেমন, সূর্যের ছায়া সূর্য বিদ্যমান হওয়ার প্রমাণ করে।
কাইফা মদ্দা জেল্লে নক্শে আউলিয়াস্ত,
কো দলিলে নূরে খুরশীদে খোদাস্ত।
আন্দর ইঁ ওয়াদীয়ে মরো বেইঁ দলীল,
লা উহেব্বুল আফেলীন গো চুঁ খলীল।
অর্থ: মাওলানা বলেন, দেখো, আল্লাহ্তায়ালা তাঁহার ছায়া কীভাবে বিস্তার করেন। যেমন, প্রকাশ্যে ছায়া সূর্য বিদ্যমান হওয়ার প্রমাণ করে, সেইরূপভাবে অলিয়ে কামেল আল্লাহর নূরের পরিচয় বহন করেন। অর্থাৎ, আল্লাহকে কীভাবে পাওয়া যায়, সেই পথ কামেল অলিগণ প্রদর্শন করিয়া থাকেন। যদি কেহ আল্লাহর অনুসন্ধান করিতে চাও, তবে কামেল মোরশেদ ব্যতীত কেহ সেই পথে পা রাখিও না। কেননা, ঐ পথ অত্যন্ত বিপজ্জনক। নেতা বা মুরব্বিবিহীন চলিতে আরম্ভ করিলে শয়তান চিরতরে গোমরাহ করিয়া ফেলিতে পারে। ঐ পথে চলিতে চলিতে কোনো অলৌকিক ঘটনা দেখিলে, হজরত ইব্রাহীম (আ:)-এর ন্যায় ‘লা-উহেব্বুল আফেলীন’ বলিতে হইবে। অর্থাৎ, আমি কোনো ধ্বংসশীল বস্তুকে ভালোবাসি না।
রোজে ছায়া আফতাবেরা বইয়াব,
দামানে শাহ্ শাম্ছে তিবরেজী বতাব।
রাহ্ না দানী জানেবে ইঁ ছুর ও উর্ছ,
আজ জিয়া উল হক হুচ্ছামুদ্দীন বপোরছ।
অর্থ: মাওলানা বলেন, পীরে কামেল যখন আল্লাহর ছায়ামাত্র এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের প্রধান উপায়, তখন তাহাদের অসিলায় জাতে পাকের মহব্বত হাসিল করো। তারপর নিজের সময়ের কামেলীনদের নাম উল্লেখ করিয়া মওলানা বলিতেছেন, এই নেয়ামত জনাব শামছুদ্দীন (শমসের) তিবরীজি (রহ:)- এর অসিলা ধরিলে অতি সহজে হাসিল করা যায়। যদি তাঁহার নিকট পৌঁছিতে না পারা যায়, তবে তাঁহার শিষ্য জিয়াউল হক হুস্সামুদ্দীনের নিকট গেলেও পাওয়া যাইতে পারে। কারণ, তিনি ইমাম শামসুদ্দীন তিবরীজির নিকট হইতে ফায়েজ-প্রাপ্ত হইয়াছেন।
ওয়ার হাছদ গীরাদ তোরা দর রাহে গুলু,
দর হাছাদে ইব্লিছরা বাশদ গুলু।
কো জে আদম (আঃ) নংগে দারাদ আজ হাছাদ,
বা ছায়াদাতে জংগে দারাদ আজ হাছাদ
উকবায়ে জিইঁ ছোওব তর দররাহে নিস্ত।
আয়ে খানাক আ কাশ হাছাদ হামরাহ নিস্ত।
ইঁ জাছাদ খানায়ে হাছাদ আমদ বদাঁ,
কাজ হাছাদ আলুদাহ্ বাশদ খান্দা।
খানো মানে হা আজ হাছাদ বাশদ খারাব,
বাজো শাহীঁ আজ হাছাদ্ গরদাদ্ গুরাব।
অর্থ: মাওলানা বলেন, যদি কাহারো ইমাম শামসুদ্দীন তিবরীজি (রহ:) অথবা জিয়াউল হক হুস্সামুদ্দীনকে অনুসরণ করিতে অহংকার হয় যে, আমি কাহারো চাইতে সম্মানে কম নহি, তবে তাহা হিংসা ব্যতীত আর কিছুই নয়। তাই মওলানা হিংসার ফলাফল বর্ণনা করিতে আরম্ভ করিয়া দিয়াছেন। তিনি বলেন, যদি সত্য ও সৎপথ ধরিতে কাহারও হিংসার উদ্রেক হয়, তবে বুঝিতে হইবে যে হিংসার পথ ইব্লিসের পথ। হজরত আদম (আ:)-কে সেজদা করিতে অত্যন্ত লজ্জাবোধ করিয়াছিল। হিংসার বশবর্তী হইয়া আদমকে সেজদা করা হইতে বিরত রহিয়াছিল। মারেফাতের পথে হিংসার চাইতে ক্ষতিকারক বস্তু আর কিছুই নাই। ঐ ব্যক্তি অত্যন্ত সৌভাগ্যশালী, যাহার মধ্যে হিংসার লেশমাত্র নাই। হিংসা শারীরিক খেয়ালের দরুন সৃষ্টি হয়। যেমন ক্রোধ ও কামভাব সৃষ্টি হয়। উহা দ্বারা স্বার্থপরতা ও অহংকার সৃষ্টি হয়। যদ্বারা অন্যের উপর প্রভাব বিস্তার করিতে উদ্যত হয়। সেই কারণেই হিংসা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়। এই জন্য মাওলানা বলেন, এই দেহ-ই হিংসার ঘর জানিয়া রাখো, এই হিংসার দ্বারাই দেহের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নষ্ট হইয়া যায়; জ্ঞান, বুদ্ধি খারাপ হইয়া যায়। প্রকৃতপক্ষে ঐ সমস্ত বস্তু অতি গুরুত্বপূর্ণ অসিলা, যাহা দ্বারা অতি সম্মান লাভ করা যায়। কিন্তু কাঁকের ন্যায় নানা প্রকার হিলা সাজী করিয়া নাজাসাত ভক্ষণ করিয়া ইতরে পরিণত হইয়া গিয়াছে। এইজন্য হিংসা-দ্বেষ পরিত্যাগ করিয়া কামেল পীরের সোহবাত ইখ্তিয়ার করো। কারণ, অলি-আল্লাহর উপর হিংসা করিলে নানা প্রকার বিপদ মুছিবাত আসে এবং অবশেষে ধ্বংস হইয়া যাইতে হয়। এই জগতে আল্লাহতায়ালা বহু অলি-আল্লাহকে গুপ্ত রাখিয়াছেন। কেননা, তাঁহাদের বিরোধিতা করিলে বহু লোক ধ্বংস হইয়া যাইবে।
গার জাছাদ খানায়ে হাছাদ বাশদ ওয়ালেকে,
ইঁ জাছাদ রা পাক করদ আল্লাহ্ নেক,
ইয়াফ্ত পাকী আজ জনাবে কিব্রিয়া,
জিছমে পুর আজ হেক্দোজে কেবরো রিয়া।
তাহেহ্রা বায়তি বয়ানে পাকিস্ত,
গঞ্জে নুরাস্ত আজ তেলেছমাশ খাকিস্ত।
অর্থ: যখন দেহ-ই হিংসার কারখানা, তবে সে দেহ তো অলি-আল্লাহরও আছে, তখন তাঁহারাও হিংসা, ক্রোধ, লোভ- লালসা হইতে পবিত্র নন। তাঁহাদের অনুসরণ করলে অন্যের কী উপকার সাধিত হইতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে যাইয়া মাওলানা বলেন, যদিও দেহ হাসাদ-এর কারখানা হয়, কিন্তু কামেল লোকের দেহ রিয়াজাত ও মোজাহেদাহ করার দরুণ আল্লাহ্তায়ালা পূর্ণভাবে পাক করিয়া দিয়াছেন। যে মানবদেহ হিংসা, অহঙ্কার ও তাকাব্বরীতে পরিপূর্ণ ছিল, আল্লাহ্তায়ালা তাঁহাদের রিয়াজাত ও মোজাহেদার কারণে দেহসমূহ সম্পূর্ণ পবিত্র করিয়া দিয়াছেন। যেমন, আল্লাহ্তায়ালা পবিত্র কুরআনে হজরত ইব্রাহীম ও হজরত ঈসমাইল (আ:)-দ্বয়কে ফরমাইয়াছেন, “তোমরা উভয়েই আমার ঘরকে অর্থাৎ কাবাকে পবিত্র রাখো। “ এই আয়াত দ্বারা ইশারা সূত্রে বুঝা যায় যে, অন্তরকে পবিত্র করার নির্দেশ আছে। এইজন্য কামেল লোকে নিজেদের অন্তঃকরণ কু-রিপু হইতে পবিত্র করিয়া লইয়াছেন। যদিও প্রকাশ্যে তাঁহাদের কলবের খাঁচা মাটির দেহ। কিন্তু, প্রকৃতপক্ষে উহা আল্লাহ্র নূরের ভাণ্ডার।
চুঁ কুনি বর বে হাছাদ মকরো হাছাদ,
জাঁ হাছাদ দেলরা ছিয়াহি হা রাছাদ।
খাফে শো মরদানে হকরা জীরে পা,
খাকে বরছারে কুন হাছাদরা হামচুমা।
অর্থ: মাওলানা বলেন, যখন তোমার জানা হইল যে কামেল লোকের অন্তরে হাসাদ নাই, তখন তাঁহাদের উপর হাসাদ করা অতিশয় ক্ষতিকারক। কেননা, হিংসাশূন্য মানুষের উপর হিংসা করিলে অন্তঃকরণ গুণাহের দরুণ অন্ধকার হইয়া যায়। এইজন্য খাঁটি কামেল লোকের অনুকরণ করা চাই। তাঁহাদের পায়ের ধূলা হইয়া যাও এবং হিংসার মাথায় লাথি মারিয়া দূর করিয়া আমার ন্যায় শামছুদ্দীন তিবরীজীর অনুসরণ কর। ইহার পর মাওলানা বলেন, ইহুদী উজির হিংসার বশবর্তী হইয়া নিজের ক্ষতি স্বীকার করিয়া কান ও নাক কাটাইয়া লইয়াছে।
হিংসা ও উজিরের ঘটনা বর্ণনা
আঁ উজিরকে আজ হাছাদ বুদাশ নাসাদ,
তা বা বাতেল গোশো বীনি বাদ দাদ।
বর উমেদে আঁকে আজীনাশ হাছাদ,
জে হর উ দর জানে মিছ্কীনানে রছাদ।
অর্থ: ইহুদী উজিরের জন্মের মধ্যে হাসাদ পরিপূর্ণ ছিল। তাই বিনা কারণে নিজের নাক ও কান কাটিয়া নিজের ক্ষতি স্বীকার করিয়া লইয়াছিল। আশা করিয়াছিল যে, তাহার এই হিংসার চাল দ্বারা গরীব নাসারাদের প্রাণে ইহার বিষ ছড়াইয়া পড়িবে এবং ধ্বংস হইয়া যাইবে।
হর কাছে কো আজ হাছাদ বীনিকুনাদ,
খেশতন বে গোশ ও বে বীনি কুনাদ।
বীনি আঁ বাশদ কে উ বুয়ে বুরাদ,
বুয়ে উরা জানেবে কোয়ে বুরাদ।
হরকে বুয়ে আশ নিস্তে বে বীনি বুদ,
বুয়ে আঁ বুয়ে আস্ত কো দীনিবুদ।
অর্থ: যে ব্যক্তি হিংসার কারণে সত্যকে অস্বীকার করে, সে নিজের কান ও নাক কাটিয়া বসে। অর্থাৎ, হিংসার দরুণ নিজের বিবেকশক্তি লোপ পাইয়া বসে। ভাল ও মন্দ বিচার করিতে পারে না। যাহার এই বিবেকশক্তি আয়ত্ত্বে থাকে, অর্থাৎ যাহার বিবেচনা করার শক্তি থাকে, তাহাকে আল্লাহর নৈকট্য লাভের পথে তাহা পৌঁছাইয়া দেয়। যাহার ভাল-মন্দ বিবেচনা করার শক্তি থাকে না, সে প্রকৃতপক্ষে নাকশূন্য, ঘ্রাণ লইবার শক্তিশূন্য। কেননা, যে ব্যক্তি ঘ্রাণশক্তি দ্বারা আল্লাহ্র পথ বাছিয়া লইতে পারে না, সে শক্তি থাকা আর না-থাকা একই রকম। এইজন্য তাহাকে বিবেক ও বিবেচনাহীন বলা হইয়াছে।
চুঁকে বুয়ে বুরাদ ও শোকরে আঁ না করদ,
কুফ্রে নেয়ামত আমদ ও বীনাশ খোজাদ।
শোক্রে কুন মর শাকেরে আঁ রা বান্দা বাশ্
পেশে ইশাঁ মোরদাহ্ শো পায়েন্দাহ্ বাশ।
চুঁ উজির আজ রাহ্জানি মায়ায়ে মছাজ,
খলকেরা তু বর মইয়াওর আজ নামাজ।
অর্থ: এখানে মাওলানা কামেল লোকের সোহবত লাভ করার জন্য বলিতেছেন, যদি কামেল লোকের কথাবার্তা দ্বারা বুঝা যায় যে তিনি কামেল; তাহার পর যদি তাঁহার সেবা না করা হয়, তবে নেয়ামতের কুফরি করার লাজেম আসে। ইহাতে বিবেক-বুদ্ধি লোপ পাইয়া যায়। যেমন আল্লাহ্তায়ালা বলিয়াছেন, যদি তোমরা কুফরি করো, তবে নিশ্চয় আমার শক্ত আজাব দেখিতে পাইবে। অতএব, কামেল লোকের আনুগত্য স্বীকার করিয়া তাঁহাদের সেবায় আত্মনিয়োগ করো এবং তাঁহাদের সম্মুখে নিজেকে মৃতের ন্যায় করিয়া রাখো। তাহা হইলে চিরস্থায়ী জীবন লাভ করিতে পারিবে। কামেল লোকের শিক্ষা ত্যাগ করিয়া ইহুদী উজিরের ন্যায় মজুর হইয়া ধর্ম্মাবলম্বীদের ডাকাতে পরিণত করিও না এবং লোকজনকে নামাজ পড়া হইতে ফিরাইয়া রাখিও না।
বুদ্ধিমান নাসারাদের উজিরের ধোকাবাজী বুঝিতে পারা
নাছেহ্ দীন গাস্তাহ্ আঁ কাফের উজির,
গরদাদ উ আজ মক্কর দর বুজিনাছের।
হরকে ছাহেবে জওকেবুদ আজ গোফ্তে উ,
লজ্জতে মী দীদ ও তলখে জুফ্তে উ।
নোক্তাহা মী গোফ্ত উ আমীখ তাহ,
দর জুলাবো ও কান্দে জহরে রীখ্তাহ।
অর্থ: উক্ত কাফের উজির, ধর্মের নসীহতকারী সাজিয়াছিল। নসীহতের মধ্যে ধোকাবাজীর কথা মিশ্রিত করিয়া বলিত। যেমন, মিঠা হালুয়ার মধ্যে কিছু রসুন মিশ্রিত করিয়া দিত। যে সমস্ত লোক আল্লাহ্র পথে ধার্মিক ছিল, তাঁহারা তাহার কথায় স্বাদ পাইতেন, কিন্তু সাথে সাথে কিছু তিক্ততা অনুভব করিতেন। সে ধর্মের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কথা বর্ণনা করিত, কিন্তু উহার মধ্যে শয়তানী ও গোমরাহির কথা বলিত – যেমন মিশ্রিত শরবতে কিছু বিষ মিশাইয়া দিত।
হাঁ মশো মাগরুরে জাঁ গোফ্ত নেকু,
জাঁকে বাশদ ছদ বদী দর জীরে উ।
হরকে বাশদ জেশ্তে গোফ্তাশ জেশ্তে দাঁ
হরচে গুইয়াদ মোরদাহ আঁরা নিস্তে জাঁ।
গোফ্তে ইনছান পারায়ে ইনছান বুদ
পারায়ে আজনানে ইয়াকীন হামনানে বুদ।
অর্থ: মাওলানা বলেন, এই সমস্ত ধোকাবাজদের মুখের সুন্দর কথায় ভুলিতে হইবে না। ইহাদের অন্তরে শত শত প্রকারের খারাবি নিহিত আছে। যে ব্যক্তি খারাপ চরিত্রবিশিষ্ট হয়, তাহার কথায়ও খারাপ ক্রিয়া করে এবং মৃত্যু অন্তঃকরণ-বিশিষ্ট ব্যক্তি যাহা বলিবে, উহাতেও কোনো ভাল ক্রিয়া করিবে না। কেননা, মানুষের কথা মানুষের একটা অংশমাত্র।মানুষটি যেরূপ হইবে, তাহার কথাও সেইরূপ হইবে। যেমন রুটির অংশ রুটি-ই হয়।
জাঁ আলি ফরমুদ নকলে জাহে লাঁ,
বর মুজাবেল হাম চু ছবজাস্ত আয় ফুলাঁ।
বরচুনাঁ ছবজাহ হর আঁকাছ কো নেসাস্ত,
বর নাজাছাত বে শক্কে ব নেশাস্তাস্ত।
বাইয়াদাশ খোদরা ব মোস্তান জা আঁ হদছ,
তা নামাজে ফরজে উ-না বুদ আবাছ।
অর্থ: হজরত আলী (ক:) রলিয়াছেন, জাহেলের নেয়ামত এইরূপ, যেমন পায়খানার সারের উপর শাক-সব্জি লাগান হয়। দেখিতে তরতাজা ও শ্যামলা, অতি চমৎকার; কিন্তু অভ্যন্তর ভাগ নাপাক ও দুর্গন্ধময় হয়।
ভাব: মাওলানা এখানে হজরত আলী (ক:)-এর কথার উদ্ধৃতি দিয়া দেখাইয়াছেন, যে ব্যক্তির অন্তর আল্লাহর মারেফাতের আলো হইতে খালি, তাহার কথাবার্তা ও উপদেশ ঐ প্রকার নেয়ামত যেমন পায়খানার সারের উপর শাক-সব্জির বাগান। প্রকাশ্যে খুব চাকচিক্য দেখায়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে উহা দুর্গন্ধময় ও নাপাক। এই রকম শাক-সব্জির উপর কেহ ধোকায় পড়িয়া গেলে সে নাপাক হইয়া যাইবে – নাপাকের উপর বসিয়াছে বুঝিতে হইবে। এই রকমভাবে ঐ ব্যক্তির কথার উপর কেহ বিশ্বাস করিয়া আমল করিলে নিশ্চয় সে ধ্বংস হইয়া যাইবে। তাহার উচিত নিজেকে ঐ নাপাকী হইতে ধৌত করিয়া পবিত্র করা, আর কখনও ঐরূপ ব্যক্তির কথায় বিশ্বাস না করা এবং তাহার উপর আমল না করা। তওবা করিবে, যাহাতে ফরজ নামাজ নষ্ট হইয়া না যায়।
জহেরাশ মীগোফ্ত দররাহে চুস্ত শো,
ওয়াজ আছর মীগোফ্ত জানরা ছোস্ত শো।
জাহেরে নকরাহ্ ছুপিদাস্ত ও মনির,
দস্তো জামা জা আঁ চিয়াহ্ গরদাদ চু কীর।
আতেশ আজ চে ছার খরবীস্ত আজ শরার,
আজ ফেলে উ ছিয়াহ্ কারী নেগার।
বরকে গার নূরে নোমাইয়াদ দর নজর,
লোকে হাস্ত আজ খাছিয়াত দোজদে বছর।
অর্থ: ঐরূপ লোকের কথায় প্রকাশ্যে বুঝা যায় যে, আল্লাহর পথে খুব হুঁশিয়ার থাকো এবং সত্য ও ন্যায়ের পথে দৃঢ় থাকো। কিন্তু ইহার কথায়, মূলে কোনো ক্রিয়া নাই। বরং সৎকাজে দুর্বলতা আরো বাড়িয়া যায়। কেননা, উক্ত উপদেশ সৎ উদ্দেশ্য ও সততাপূর্ণ ছিল না। শুধু লোক দেখানো ও ধোকা দিবার নিয়তে ছিল। (একটি উদাহরণ দিয়া মাওলানা বলিতেছেন), ঐ উপদেশগুলি যেমন চান্দির মত ধপধপে সাদা দেখায়। কিন্তু কাপড় এবং হাতের সাথে স্পর্শ করিলে কালো হইয়া যায়। এই রকম অগ্নির প্রতি লক্ষ্য করো, প্রকাশ্যে দেখিতে লাল দেখায়, কিন্তু উহার ক্রিয়া কালো। বিজ্লিও এই রকম দেখিতে আলো, কিন্তু চক্ষের জ্যোতি হরণ করিয়া নিয়া যায়।
হরফে জুজ আগাহ্ ও ছাহেব ও জওকে বুদ,
গোফ্তে উ দর গরদানে উ তওকে বুদ।
মুদ্দাতে শশ ছালে দর হেজরানে শাহ্,
শোদ উজির ইত্তেবায়ে ঈছারা পানাহ্।
দীন ও দেলরা কুল বদু বছপরদে খল্ক,
পেশে আমর ওনিহি উ মি মরদে খল্ক।
অর্থ: মাওলানা এখানে অজ্ঞ জনসাধারণের অবস্থা বর্ণনা করিয়া বলিতেছেন, যাহাদের কোনো জ্ঞান বা বিবেক শক্তি ছিল না, তাহারা উজিরের কথা গলার হার বানাইয়া পরিধান করিয়া লইয়াছিল এবং তাহার জন্য পাগল হইয়া গিয়াছিল। এই রকমভাবে ছয় বৎসর বাদশাহর নিকট হইতে দূরে থাকিয়া উজির নাসারাদের নেতা ও ভরসাস্থল হইয়া দাঁড়াইলো। সমস্ত নাসারাদের প্রাণ উজিরের হাতে সমর্পণ করিয়া দিল। তাহার আদেশ ও নিষেধের প্রতি জান-কোরবান করিয়া দিত।
গুপ্তভাবে বাদশাহ উজিরের নিকট খবরাখবর পাঠান
দর মীয়ানে শাহ ও উ পয়গামে হা,
শাহ রা পেনহানে বদু আরামে হা।
আখেরাল আমরে আজ বরায়ে আঁ মুরাদ,
তা দেহাদ চুঁ খাকে ইশাঁরা ববাদ।
পেশে উ ব-নাবেস্ত শাহ কা আয়ে মুকবেলাম,
ওয়াক্তে আমদ জুদে ফারেগ কুন ও লাম।
জে ইন্তে জারাম দীদাহ ও দেল বররাহে আস্ত,
জে ইঁ গমাম আজাদ কুন গার ওয়াক্তে হাস্ত।
গোফ্তে ইনাক আন্দার আঁ কারাম শাহা,
কা আফগানাম দর দীনে ঈছা ফেতনাহা।
অর্থ: গুপ্তভাবে উজির এবং ইহুদী বাদশাহর মধ্যে খবরাখবর চলিতেছিল। বাদশাহ্র অন্তরে উজিরের উপর পূর্ণ আস্থা ছিল। অবশেষে নাসারাদিগকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করার জন্য বাদশাহ্ উজিরের নিকট লিখিলেন, “হে সৌভাগ্যবান, এখন সুযোগ আসিয়াছে, শীঘ্র করিয়া আমাকে সান্ত্বনা দাও। আমার চক্ষু ও অন্তর অপেক্ষায় রহিয়াছে। তোমারও যদি এখন সুযোগ হইয়া থকে, তবে এই চিন্তা হইতে আমাকে মুক্ত কর। উজির প্রতিউত্তরে লিখিয়াছিল, আমিও এই চিন্তায় সর্বদা নিযুক্ত আছি যে ঈসায়ী ধর্ম সম্পূর্ণরূপে বিলীন করিয়া দিব।
নাসারাদের বার নেতার বর্ণনা
কওমে ঈছারা বুদ আন্দর দারো গীর,
হাকেমানে শানে দাহ আমীর ও দো আমীর।
হর ফরিকে হর আমীরে রা তাবেয়,
বান্দাহ গাস্তাহ মীরে খোদ্রা আজ তামেয়।
ইঁ দাহ ও ইঁ দো আমীর ও কওমে শাঁ।
গাস্তে বান্দাহ আঁ উজিরে বদ নেশাঁ।
ইতেমাদে জুমলা বর গোফ্তারে উ।
ইক্তে দায়ে জুমলা বর রফ্তারে উ।
পেশে উ দর ওয়াক্তে ও ছায়াতে হর আমীর,
জানে ব দাদী গার বদু গোফ্তীকে আমীর।
চুঁ জবুন করদে আঁ হছুদাক জুমলারা,
ফেতনা আংগিখ্ত আজ মকর ও দেহা।
অর্থঃ:প্রশাসনিক ব্যাপারে ঐ নাসারাদের বারজন নেতা ছিল। প্রত্যেক নেতার একেক দল ছিল। জাগতিক উপকারার্থে নেতাদিগকে মান্য করিত। অতএব, উক্ত বার নেতা এবং তাহাদের শিষ্য-শাগরেদ প্রত্যেকেই ঐ কমিনা ইহুদী উজিরের বশবর্তী হইয়া গিয়াছিল। সকলেই তাহার কথায় বিশ্বাস করিত এবং তাহাকে অনুসরণ করিত। উজিরকে এমন ভাবে মান্য করিত যে, যদি সে মরিতে বলিত, তবে তৎক্ষণাৎ মরার জন্য প্রস্তুত হইত। অবশেষে যখন কমিনা উজির সকলকে বাধ্যগত করিয়া লইল, তখন ধুরন্ধর উজির চালাকি করিয়া মারাত্মক একটি নূতন ফেতনা আবিষ্কার করিল।
উজিরের ইঞ্জিল কিতাব রদ-বদল করা।
ছাখ্তে তুমারে বনামে হর কাছে,
নকশে হর তুমার দূীগার মাছলাকে।
হুক্মহায়ে হরি এক নুয়ে দীগার,
ইঁ খেলাকে আঁজে পায়ানে তা জেছার।
অর্থ: এখানে নূতন আবিষ্কৃত ফিতনার কথা বলা হইয়াছে। উক্ত উজির প্রত্যেক নেতার নামে একখানা কপি তৈয়ার করিল। প্রত্যেক কপির মর্ম অন্য হইতে বিরুদ্ধে ছিল। প্রত্যেক কপির মধ্যে নূতন নূতন আহ্কাম লিপিবদ্ধ করা হইয়াছিল। একে অন্যের সম্পূর্ণ বিপরীত মর্ম ধারণ করিয়াছিল।
দর একে রাহে রিয়াজাত রা ও জুউ,
রোকনে তওবা করদাহ ওশরতে রুজুউ।
দর একে গোফ্তাহ রিয়াজাত ছুদে নিস্ত,
আন্দর ইঁ রাহ্ মোখলেছি জুজ জুদে নিস্ত।
অর্থ: এখানে মাওলানা কপির কয়েকটি পরস্পরবিরোধী আহ্কামের বর্ণনা দিয়াছেন। যেমন, এক কপিতে রিয়াজাত ও ভূখা থাকাকে তওবার পদ্ধতি ও আল্লাহ্র প্রতি মনোনিবেশ করার পন্থা বলিয়া প্রকাশ করিয়াছে। অন্য এক কপিতে লিখিয়া দিয়াছে যে, রিয়াজাত দ্বারা কোনো উপকার হয় না। আল্লাহকে পাইতে হইলে দান-সদ্কা ছাড়া আর কিছু দ্বারা পাওয়া যায় না। একই মসলা সম্বন্ধে কপিদ্বয়ের মধ্যে ভিন্নরূপ বর্ণনা করা হইয়াছে।
দর একে গোফ্তাহ-কে জুদ ও জুউ তু,
শেরকে বাশদ আজ তু বা মায়াবুদে তু।
জুজ তাওয়াক্কুল জুজকে তাছলীমে তামাত,
দরগমে দর রাহাতে হামা মকরাস্ত ওদাম।
দর একে গোফতাহকে ওয়াজেবে খেদ মতাস্ত,
ওয়ার না আন্দেশাহ তাওক্কাল তোহ্মাতাস্ত।
অর্থ: অন্য এক কপিতে লিখিয়া দিল, দান, সদ্কা ও ভূখা থাকা মাবুদের সহিত শরীক করা ব্যতীত আর কিছুই নহে। কেননা, উহা দ্বারা নিজের কার্যকলাপ ও গুণ-গরিমার পূর্ণত্বের উপর নির্ভর করার ধারণা আসে। অতএব, ঐ দুই পন্থা ত্যাগ করিয়া তাওয়াক্কুল অবলম্বন কর এবং সুখে দুঃখে আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট থাকো। এই সমস্ত বর্ণনা সকলই তাহার ধোকাবাজী ছিল। অন্য এক কপিতে লিখিয়া দিয়াছিল যে, তাওয়াক্কুল দ্বারা কোনো ফায়দা হয় না। সেবা ও আনুগত্য প্রকাশ করা চাই। তাওয়াক্কুলের কথা চিন্তা করা অর্থ নবীদের উপর শুধু দোষারোপ করা; আদেশ নিষেধ সবই বেহুদা বলিয়া মনে করা হয়।
দর একে গোফ্তাহ কে আমর ও নেহি হাস্ত,
বহর করদান নিস্তে শরাহ ইজ্জো মাস্ত।
তাকে ইজ্জে খোদ বা বীনাম আন্দর আঁ,
কুদরাতে আঁরা বদানেম আঁ নজমাঁ।
দর একে গোফতাহ্ কে ইজ্জেখোদ মুবীন,
কুফ্রে নেয়ামত করদানাস্ত আঁ ইজ্জেহীন।
কুদরাতে খোদ বী কে ইঁ কুদরাত আজ উস্ত,
কুদরাতে তু নেয়ামতে উ দাঁকে হুস্ত।
দর একে গোফ্তাহ কাজ ইঁ দো দর গোজার
বুতে বুদ হরচে ব গুঞ্জাদ দর নজর।
অর্থ: এক নোছখায় লিখিয়া দিল, এই যে সমস্ত আদেশ নিষেধ আছে, ইহা আমাদের পালন করার জন্য নয়; শুধু আমাদের ক্লান্তি ও অপরাগতা প্রকাশের জন্য দেওয়া হইয়াছে, যাহাতে আমরা অপারগ হইয়া আল্লাহ্র কুদরত দেখিতে পারি। তখন আল্লাহর কুদরতের উপর আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন হইবে। এই নোছখার সারমর্ম হইল জবরিয়া মোজহাব। অন্য এক কপিতে লিখিয়া দিয়াছে, নিজের অপরাগতা দেখা এক প্রকার না-গুক্রি প্রকাশ করা বুঝায়। অর্থাৎ, খোদাতায়ালা বান্দাকে যে নেয়ামতস্বরূপ শক্তি প্রদান করিয়াছেন, উহার প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা বুঝা যায়। ইহা কুফরির মধ্যে গণ্য করা হয়। অতএব, শক্তির প্রভাব দেখান চাই। অন্য এক কেতাবে লিখিয়া দিয়াছে যে, যবর ও কদর উভয়কেই বাদ দিয়া দেখিতে হইবে। কেননা, ইহার যে কোনোটার প্রতি লক্ষ রাখিলে প্রতিমার সমতুল্য হয়। প্রতিমার প্রতি লক্ষ্য রাখিতে গেলে আল্লাহর তরফ হইতে খেয়াল ছুটিয়া যায়। এখানে হওয়া আর না হওয়ার মধ্যে দ্বন্দ্ব রহিয়াছে।
দর একে গোফ্তাহ কে ইজ্জো ও কুদরাতুত,
বোগ জারাদ ওজে হরচে আন্দর ফেক্রেতুত।
আজ হাওয়া খেশে দর হর মিল্লাতে,
গাস্তাহ্ হর কওমে আছিরে জিল্লাতে।
অর্থ: এক কপিতে বর্ণনা করিয়াছে, তোমার মধ্যে যে অপরাগতা ও শক্তি ইচ্ছাধীন রহিয়াছে, উহা দূর করার জন্য কোনো চেষ্টা বা তদবীর করিতে হইবে না। ঐ সব চিন্তা বা খেয়াল আপন হইতেই দূর হইয়া যাইবে। উহা দূর করার জন্য নিজে কোনো চেষ্টা করাও আত্মার কু-রিপুর অংশ বলিয়া বিবেচিত। উহা অপমানজনক কাজ। আত্মার আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী যে জাতি কাজ করে, সে জাতি পৃথিবীতে সর্বদা অপমানিত থাকে।
দর একে গোফ্তাহ মকোশ ইঁ শামেয়রা,
কা ইঁ নজর চুঁ মামেয় আমদ জমেয় রা।
আজ নজর চুঁ বোগজারী ও আজ খেয়াল,
কোশতাহ্ বাশী নিমে শবে শামায় বেছাল।
দর একে গোফ্তাহ বকুশ বাকে মদার,
তা ইওজে বীনি একেরা ছদ হাজার।
কে জে কুস্তানে শামেয় জানে আফজুঁ শওয়াদ,
লাইলাতে আজ ছবরে তু মজনুন শওয়াদ।
তরকে দুনিয়া হরকে করদ আজ জোহদে খেশ,
বেশে আমদ পেশে উ দুনিয়াও পেশ।
অর্থ: অন্য এক জায়গায় লিখিয়াছে, নিজের মধ্যে যে শক্তি ও খেয়াল আছে, ইহা দূর করিও না। কেননা, ইহা মোমবাতির আলোর ন্যায়, ইহা বন্ধ করিয়া দিও না। যদি বন্ধ কর, তবে ঐ ব্যক্তির ন্যায় হইবে, যে ব্যক্তি মাশুকের সাথে মিলনের রাত্রে অর্ধ রাত্রিতে আলো নিভাইয়া ফেলিয়া দিয়াছে; যে আলো দিয়া মন্দ অনুমান করিয়া নিবে, উহা দূর করিয়া দিলে কেমন করিয়া সে আসল উদ্দেশ্য লাভ করিবে। অতএব, তোমাদের মধ্যে যে বুদ্ধি জ্ঞান আছে তাহা দূর করিও না। অন্য এক স্থানে লিখিয়া দিয়াছে, যে ব্যক্তি নিজের ইচ্ছায় দুনিয়া ত্যাগ করিয়াছে, সে এক দুনিয়ার পরিবর্তে লাখো দুনিয়া প্রাপ্ত হইয়াছে। অতএব, তুমি নিজের বুদ্ধি ও খেয়াল ত্যাগ করিতে মোটেও ভয় করিও না। কারণ, তুমি এই আকল ও বুদ্ধি ত্যাগ করিতে পারিলে লাখো গুণ বেশী মূল্যবান বস্তু পাইবে। অর্থাৎ, বুদ্ধি ত্যাগ করিতে পারিলে ভবিষ্যতে ইল্হাম পাইতে পারিবে এবং যত দিন পর্যন্ত তুমি বুদ্ধি ও বিবেক ত্যাগ করিয়া স্থায়ী থাকিতে পারিবে, ততদিন পর্যন্ত তোমার মাহবুব অর্থাৎ তোমার খোদা তোমার উপর সন্তুষ্ট থাকিবেন। এইটা হইল দ্বিতীয় নেয়ামত। যে ব্যক্তি নিজে চেষ্টা ও মেহনত করিয়া দুনিয়া ত্যাগ করিতে পারিবেন, সে নিজের কাছে দুনিয়াকে আরো বেশী পাইবে। এইভাবে জ্ঞান ত্যাগ করিতে পারিলে, ইহার বিনিময়ে অধিক মূল্যবান বস্তু পাইতে পারিবে। যেমন, খোদার তরফ হইতে ইলহাম প্রাপ্ত হওয়া, খোদার মাহবুব হওয়া ইত্যাদি।
দর একে গোফতাহ আঁ চাত দাদে হক,
বর তু শিরীন করদ দর ইজাদে হক।
বর তু আছান করদ খোশ আঁরা বগীর
খেশতনরা দর মী গফন দর জে হীর।
দর একে গোফ্তাহ কে বোগজার জে আঁ খোদ
কা আঁ কবুলে তাব্য়া বুদে তু জেস্তাস্ত ও বাদ।
রাহ্ হায়ে মোখতালেফ আছান শোদাস্ত,
হর্ একে রা মিল্লাতে চুঁ জানে শোদান্ত।
গার মাইয়াচ্ছার করদানে হক রাহ্ বুদে,
হর জহুদো গবার আজু আগাহ্ বুদে।
দর একে গোফ্তাহ মাইয়াচ্ছার আঁ বুদ,
কে হায়াতে দেল গেজায়ে জানে বুদ।
হরচে জওকে তাব্য়া বাশদ চু গোজাস্ত,
বর নাইয়ারাদ হামচু শুরাহ্ রীয়ে ওকাস্ত।
জুজ পেশেমানী নাবাশদ রীয়ে উ,
জুজ খেছারাত পেশে না আরাদ বায়ে উ।
আঁ মাইয়াচ্ছার না বুদ আন্দর আকেবাত,
নামে উ বাশদ মোয়াচ্ছার আকেবাত।
তু মোয়াচ্ছোর আজ মুইয়াচ্ছার বাজে দাঁ,
আকেবাত বেংগার জামালে ইঁ ও আঁ।
অর্থ: এক কপিতে লিখিয়াছে, আল্লাহতায়ালা তোমাকে যে সমস্ত বস্তু দান করিয়াছেন, সবই তোমার জন্য হালাল। খোদাতায়ালা যাহা তোমার জন্য সহজ করিয়া দিয়াছেন, তুমি তাহা সন্তুষ্ট চিত্তে গ্রহণ কর। উহা ত্যাগ করিয়া নিজেকে বিপদগ্রস্ত করিও না। অন্য এক জায়গায় লিখিয়াছে, নিজের ইচ্ছা ত্যাগ করা চাই, কেননা তোমার ইচ্ছা কবুল করা খারাপ ও পাপ। কারণ, উহা হালাল হওয়া সম্বন্ধে কোন দলীল নাই। যদি শুধু কোনো বস্তু নিজের আত্মার কাছে সহজ বলিয়া মনে হওয়াই হালাল হওয়ার প্রমাণ হয়, অথবা সুন্দর হওয়া প্রমাণ হয়, তবে দুনিয়ার সমস্ত ধর্মই সুন্দর ও সত্য বলিয়া মনে করিতে হইবে। কেননা, বিভিন্ন পথে ঐ সমস্ত ধর্মাবলম্বীদের পথ সহজ বলিয়া মনে হয়। এইজন্য প্রত্যেক ব্যক্তির নিজ ধর্ম প্রাণের তুল্য প্রিয়। তবে সব ধর্মই সত্য এবং গ্রহণযোগ্য। কিন্তু এই রকম হওয়া একান্ত ভুল। খোদাতায়ালার যদি কোনো কাজ এইরূপভাবে আসান করিয়া দেওয়া পন্থা হইত, তবে ইহুদী ধর্ম সত্য বলিয়া প্রমাণ হইয়া যাইত। যাহা সহজ, তাহাই যদি সত্য হইত, তবে দুনিয়ায় কোনো পথভ্রষ্ট থাকিত না। ইহা দ্বারা বুঝা গেল যে, কোনো বস্তু সহজ ও আসান বলিয়া মনে হওয়া গ্রহণযোগ্য বলিয়া প্রমান করা যায় না। তৃতীয় এক জায়গায় লিখিয়াছে, কোনো কাজ সহজ হওয়া এবং উহা সত্য হওয়া প্রমাণ হয়, কিন্তু ইহাতে আত্মা বা ইচ্ছার কোনো প্রভাব থাকিবে না, বরং রূহ এবং কলবের ইচ্ছার উপর নির্ভর করিবে। কলবের হিসাবে সহজ হইল হায়াত এবং রূহুর হিসাবে সহজ হইল গেজা বা খোরাক। আকল বা নফসের ইচ্ছার কোনো ধর্তব্য নাই। কারণ, ইহারা সাময়িক ভালকে ভাল মনে করে, কিন্তু ক্ষণিক পরে তাহার কোনো নাম-নিশানা থাকে না। যেমন, লোনা জমিন কষ্ট করিয়া চাষ করা যায়, ফসল জন্মে না। মেহনত বরবাদ গুণাহ লাজেম। ইহা বিক্রি করিলেও লাভ হয় না। যদিও অবস্থা দৃষ্টে মনে হয় চাষ করা অতি সহজ এবং দেখিতে অতি সুন্দর, শেষ ফল ক্ষতিগ্রস্থ ও লজ্জিত হওয়া ব্যতীত কিছুই লাভ করা যায় না। তুমি সহজ ও কঠিনকে পার্থক্য করিতে শিক্ষা কর, এবং পরিণতির দিক দিয়া কোনটা ভাল ও মন্দ বুঝিতে চেষ্ট কর, তারপর তুমি ভালমন্দ বুঝিতে পারিবে।
দর একে গোফ্তাহ কে উস্তাদে তলব,
আকেবাত বীনি নাবাইয়াদ দর হছব।
আকেবাত দীদান্দ হর গোঁ মিল্লাতে,
লা জরাম গাস্তান্দ আছীরে জিল্লাতে।
আকেবাত দীদান নাবাশদ দস্তে বাফ্
ওয়ার না কায়ে বুদে জেদীনে হা ইখ্ তিলাফ।
দর একে গোফ্তাহ কে উস্তাহাম তুই,
জাঁকে উস্তারা শেনাছা হাম তুই।
মরদে বাশ ও ছোখ্রায়ে মরদা মশো,
রুছারে খোদগীর ওছারে গরদান মশো।
চশমে বর ছাররাতে ব দার ও আজ খেলাফ,
দূরে শো তা ইয়াবি আজ হক্কে ইতেলাফ।
অর্থ: এক নোছখায় লিখিয়াছে, শেষ ফল বুঝিবার শক্তি অর্জন করার জন্য উস্তাদ ধর। কেননা, উস্তাদ ব্যতীত পরিণতি বুঝিবার শক্তি অর্জন করা যায় না। শুধু বংশীয় ফজিলত ও বিদ্যা শিক্ষা করিলে পরিণতি সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করা যায় না। প্রত্যেক ধর্মের বিশ্বাসী ধার্মিকগণ নিজেদের ধর্মের পরিণতি সম্বন্ধে নবীদের অনুসরণ ছাড়া বিশেষ এক পদ্ধতি বাহির করিয়া লইয়াছে। যাহাতে তাহারা শেষ পর্যন্ত লজ্জিত ও অপমাণিত হইয়াছে। কিন্তু সত্য প্রকাশ পায় নাই। পরিণতি চিন্তা-ভাবনা করিয়া দেখা সহজ কাজ নয়। তাহা না হইলে ধর্মসমূহের মধ্যে এত মতানৈক্য সৃষ্টি হইত না। অতএব, একজন পথপ্রদর্শকের আবশ্যক। আর এক জায়গায় লিখিয়া দিয়াছে, উস্তাদ কী? তুমি নিজেই উস্তাদ। নিজে খুব চিন্তা ভাবনা করিয়া কাজ করো। কেননা শেষ পর্যন্ত তুমি-ই ত উস্তাদ পছন্দ করিয়া লইবে। যদি তোমার পছন্দ-ই ঠিক না হয় তবে তোমার উস্তাদ পছন্দ করাও ঠিক হইবে না। তবে কেমন করিয়া উস্তাদ পছন্দ করিয়া লইবে। অবশেষে তোমার চিন্তা-ই যদি ঠিক হয় এবং গ্রহণযোগ্য হয়, তবে উস্তাদের আবশ্যক কী? উস্তাদের অনুসরণ করিতে হইবে কেন। অতএব, দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ব্যক্তি হও, অপরের মুখাপেক্ষী হইও না। নিজের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী কাজ করো। পথ প্রদর্শক তালাশ করিতে কষ্ট করিও না। নিজের অন্তঃকরণের মতানুযায়ী কাজ করো। উহার বিরুদ্ধে কোনো কাজ করিও না। তাহা হইলে আল্লাহর প্রিয় বান্দা হইতে পারিবে।
দর একে গোফ্তাহ কে ইঁ জুমলা তুই,
মী নাগোঞ্জাব দরমীয়ানে মা দুই।
ইঁ হামা আগাজে মা ও আখের একে ইস্ত,
হরকে উ দো বীনাদ আহ্ওয়ালে মরদে কীস্ত।
দর একে গোফ্তাহ কে ছদ এক চুঁ বুদ,
ইঁ কে আন্দেশাদ মাগার মজনুন বুদ।
হরি একে কওলিস্ত জেদ্দে এক দীগার,
ইঁ বজেদ্দে উ জে পায়ানে তা বছার।
চু একে বাশদ বগো জহর ও শাক্কর
মোখ্তাফে দর মায়নি ওহাম দর ছুর।
দর মায়ানি ইখ্তেলাফ ও দর ছুর,
রোজ ও শব বীঁ খার ও গোল ছংগো ও গহর।
অর্থ: এক কপিতে লিখিয়া দিয়াছে, এই বিশ্বজগতে যাহা কিছু বিদ্যমান দেখিতেছ, ইহা এবং স্বয়ং আল্লাহ এক। আমাদের মধ্যে দ্বিতীয়ের স্থান নাই। তাই আমাদের আরম্ভ এবং শেষ উভয় অবস্থা-ই এক। যে ব্যক্তি পৃথক পৃথক মনে করে, ইহা শুধু তাহার মানসিক খেয়াল। অর্থাৎ, সমস্ত সৃষ্ট বস্তু এক বলিয়া রায় দিল। অন্য এক স্থানে লিখিয়া দিয়াছে, শত শত বস্তু কেমন করিয়া এক হইতে পারে। পাগল ব্যতীত এমন কথা কেহ চিন্তাও করিতে পারে না। প্রত্যেক কথাই একে অন্যের বিপরীত। পা হইতে মাথা পর্যন্ত একে অন্যের বিরোধী। যেমন, বাস্তবে ধরিয়া লওয়া হউক, বিষাক্ত বস্তু ও মিষ্টি; ইহারা কেমন করিয়া পরস্পর একই বস্তু হয়। নিশ্চয়ই ইহারা ক্রিয়ার দিক দিয়া এবং সুরতের দিক দিয়া পরস্পরবিরোধী। এই রকমভাবে প্রত্যেক জিনিসেই বিশেষত্বের দিক দিয়া বিভিন্ন প্রকারে বিভক্ত। যেমন, দিবা-রাত্রি, কাঁটা ও ফুল, পাথর ও মূল্যবান ধাতু প্রত্যেকেই বিশেষত্বের দিক দিয়া একে অন্যের বিরোধী।
তাজে জহর ও আজ শোক্কর দর না গোজারী,
কায়ে তু আজ গোলজার ওয়াহ্ দাতে বু বরী।
ওয়াহ্দাত আন্দর ওয়াহদাত আস্ত ইঁ মস্নবী,
আজ ছামাক রো তা ছামাক আয়ে মায়ানবী।
অর্থ: উপরে বস্তুসমূহের তারতম্য ও একত্বের কথা বর্ণনা করা হইয়াছে। তাই মাওলানা এখানে খোদার একত্বের কথা বলা প্রয়োজন মনে করিয়া তাওহীদের কথা বলিতেছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি জহর ও চিনির কথা ত্যাগ করিয়া অর্থাৎ এই বহুরূপী বিশ্ব হইতে তোমার খেয়াল ফিরাইয়া আল্লাহর দিকে না ফিরাইবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এক বাগিচার সুঘ্রাণ লইতে পারিবে না। অর্থাৎ, তাওহীদের স্বাদ গ্রহণ পারিবে না। কেননা, নফ্স একই সময়ে দুই দিকে খেয়াল করিতে পারে না। পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর ধ্যান না করিলে আল্লাহর মহব্বত পাওয়া যায় না। এই মসনবী শরীফে আল্লাহর একত্ব সম্বন্ধেই বেশীর ভাগ বর্ণনা করা হইয়াছে। এই জন্য তালেবের চাই ইহ-জগতের খেয়াল ত্যাগ করিয়া উর্ধ্ব জগতের পরিপূর্ণ খেয়াল করা; তবেই তাওহীদের স্বাদ গ্রহণ করিতে পারিবে।
জী ইঁ নমতে জী ইঁ নূয়ে দাহ তুমার ও দো,
বর নাবেস্ত আঁ দীনে ঈছারা আদদ।
অর্থ: এখানে মাওলানা কপিসমূহের বর্ণনা শেষ করিয়াছেন। তিনি বলেন যে, এই রকম ভাবে ঐ দুশমনে ঈসায়ী ধর্মের বারো কপি লিপিবদ্ধ করিয়া দিয়াছে।
দেখিতে বিভিন্ন পথ, প্রকৃত পক্ষে বিভিন্ন পথ নয়-ইহার বর্ণনা
উজে একে রংগী ঈছা বু নাদাস্ত
ওয়াজ মেজাজে খানু ঈছা আখু নাদাস্ত।
জামায়ে ছদ রংগে আজাঁ খামে ছাফা,
ছাদায়ে ও এক রংগে পাস্তি চুঁ জিয়া।
নিস্তে এক রংগী কাজু খীজাদ মালাল,
বাল মেছালে মাহী ও আবে জেলাল।
গারচে দর খুশ্কী হাজারাঁ রংগে হাস্ত,
মাহীয়াঁ রা বা পেইস্ত জংগে হাস্ত।
অর্থ: মাওলানা বলেন, ঐ ইহুদী উজিরের অজ্ঞতা বশতঃ হজরত ঈসা (আ:)-এর খোদার একত্ব প্রচার সম্বন্ধে কোনো জ্ঞান ছিল না এবং ঈসা (আ:)-এর বাতেনী বিদ্যার খবর রাখিত না। তাহা না হইলে ঈসা (আ:) যে মুসা (আ:)-এর বিরুদ্ধে লোকদিগকে শিক্ষা দেন না তাহা বুঝিত। বরং হজরত ঈসা (আ:) ও মুসা (আ:) একই পথে লোকদিগকে ডাকিতেন। হজরত ঈসা (আ:) নানা প্রকার মতের লোকদিগকে এক তাওহীদের পথে আনিতেন। যেমন, আলো প্রকৃতপক্ষে এক রংয়ের হয়। অনুভব করার দিক দিয়া অনেক প্রকার দেখা যায়। সর্বদা একই অবস্থায় থাকিলে লোকেরা মনে বিরক্তি বা অসুস্থতা বোধ করে। তাই মাওলানা বলিতেছেন এই এক রং এমন এক রং নয়, যাহাতে লোক অশান্তি মনে করে, বরং ইহার উদাহরণ যেমন মাছ এবং মিঠা পানি। মিঠা পানিতে মাছ সর্বদা বাস করিতে ভালোবাসে, কোনো সময়ই অশান্তি মনে করে না। যদিও স্থলে নানা প্রকার রং আছে, তথাপি মাছ কোনো সময় স্থলে তথা শুকনায় বাস করিতে পারে না। এইরূপভাবে তাওহীদপন্থীরা সব সময়ে আল্লাহর পথে থাকিতে ভালোবাসেন। আল্লাহর সাথে যোগাযোগ রাখিতে কোনো সময়েই তাঁহারা অশান্তি বা কষ্ট বোধ করেন না।
কীস্তে মাহী চীস্তে দরিয়া দর মেছাল,
তা বদাঁ মানাদ মালিকে আজ্জোজাল।
ছদ হাজারাণে বহর ও মাহী দর অজুদ,
ছেজদাহ্ আরাদ পেশে আঁ দরিয়ায়ে জুদ।
অর্থ: উপরে আল্লাহর তাওহীদকে সাগরের সহিত তুলনা করা হইয়াছে। কেহ আবার কম বুদ্ধির দরুণ আল্লাহকে সাগরের ন্যায় না বুঝিয়া বসে। এই জন্য এখানে মওলানা বলিতেছেন, সাগরের সাথে আল্লাহর মারেফাতের তুলনা খাটে না। কেননা, বিশ্বের সমস্ত সাগর একত্রিত করিয়া উহার ন্যায় আরো হাজার হাজার সাগর বিদ্যমান হইলেও খোদার সম্মুখে নগণ্য বলিয়া মনে হইবে। শুধু আংশিকভাবে কোনো এক দিক দিয়া আল্লাহর তাওহীদকে সাগরের সহিত তুলনা করা হইয়াছে। এই রকমভাবে কোনো কোনো আরেফ লোক আল্লাহতায়ালাকে সূর্য অথবা সাগর বা অন্যান্য বস্তুর সহিত তুলনা করেন। ঐরূপ তুলনা সর্ব দিক দিয়া করা হয় না। কোনো বিশেষ সম্বন্ধের জন্য করা হয়।
চান্দে বারাণে আতা বারাণে শোদাহ,
তা বদাঁ আঁ বহর দূর আফ্শা শোদাহ।
চান্দে খুরশীদ করমে আফ্রুখতাহ,
তাকে আবর ও বহরে জুদে আমুখতাহ্।
চান্দে খুরশীদ করমে তাবাঁ শোদাহ্
তা বদাঁ আঁ জররাহ ছার গরদান শোদাহ্।
পর তু দানেশ জাদাহ্ বর আব ও তীন,
তা শোদাহ দানা পেজী রান্দাহ জমীন।
খাকে আমীন ও হরচে দরওয়ে কাস্তী,
বে ভেয়ানাত জেছে আঁ পর দাস্তী।
ইঁ আমানাত জাঁ আমানাত ইয়াফতাস্ত,
কা আফতাবে আদলে বরওয়ারে তাফতাস্ত।
তা নেশানে হক নাইয়ারাদ নও বাহার,
খাকে ছেররেহা রা না করদাহ আশেকার ।
আঁ জামাদে কো জামাদে রা বদাদ,
ইঁ খবরে হা ও ইঁ আমানাত ওয়াইঁ ছাদাদ।
আঁ জামাদ আজ লুৎফে চুঁ জানে মী শওয়াদ,
জেমহ্রীর কহর পেন্হা মী শওয়াদ।
আঁ জামাদে গাস্তে আজ ফজলাশ লতিফ,
কুল্লু শাইয়েম্ মেন জরীফেন হু শরীফ।
মর জামাদে রা কুনাদ ফজলাশ খবীর,
আকেলারা করদাহ্ কাহার আও জরীর।
অর্থ: এখানে মাওলানা আল্লাহ্ জাল্লাশানুহুর আজমাত ও সমস্ত মাখলুকাতের তাঁহার দিকে মুখাপেক্ষী হওয়ার কথা বর্ণনা করিতেছেন; সমুদ্র আমাদিগকে মুক্তা দেয় এই ক্ষমতা আল্লাহতায়ালা ইহাকে রহমতের বৃষ্টি দান করিয়া দিয়াছেন। অতএব, সমুদ্রকে মুক্তা দান করার গুণ আল্লহ্তায়ালার দানের ফায়েজের বরকত। দরিয়া এবং মেঘ আমাদিগকে যে পানি দান করে, এই দানের ক্ষমতা আল্লাহ্তায়ালা মেহেরবানী করিয়া ইহাদিগকে তাপ দান করিয়াছেন, সেই দরুন ইহারা পানি দান করার ক্ষমতা প্রাপ্ত হইয়াছে। আতএব, দরিয়া ও মেঘের দানের ক্ষমতা আল্লাহতায়ালার দানের ফায়েজের ফল। সূর্য আসমানে তপ্ততা লাভ করিয়াছে, যাহার আলোতে সমস্ত পৃথিবী আলোকিত হয়। ইহা আল্লাহর অনুগ্রহে তাঁহার তাপের ক্ষমতাপ্রাপ্ত হইয়াছে বলিয়া আলো দান করিতে শিখিয়াছে; এবং জমিন যে বীজ বপণ স্বীকার করিয়া লইয়াছে, ইহার কারণ আল্লাহ্তায়ালার এলেমের প্রতিবিম্ব কাদা, মাটি ও পানির উপর পতিত হইয়াছিল। অতএব, এলেমের গুণের স্বাভাবিক চাহিদা অনুযায়ী জমিন বীজ গ্রহণ করা স্বীকার করিয়া লইয়াছিল। মাটির মধ্যে যে আমানতের গুণ দেখা যায়, এই মাটি এমন আমানতদার যে, যে প্রকারের দানা বপন করিবে, সে-ই প্রকারের ফল দান করিবে। কোনো দানাকে পরিবর্তন করিয়া অন্যরকম ফল দান করিবে না। এই আমানত রক্ষার শক্তি আল্লাহতায়ালার আমানতের সেফাত হইতে প্রাপ্ত হইয়াছে। আল্লাহতায়ালা আদেল ও পূর্ণ আমানতদার। জমিন আরও একটি গুণের অধিকারী আছে, উহা হইল, আল্লাহর এলেম সম্বন্ধে সর্বদা জ্ঞাত থাকা। যেমন, আল্লাহতায়ালা যতক্ষণ পর্যন্ত বসন্ত মৌসুমের ফরমান জারী না করিবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত জমিন শাক-সব্জী ও ফুল-ফল বাহিরে প্রকাশ করে না। আল্লাহতায়ালা এমন দাতা যে, পাথরকে এমন বিদ্যা দান করিয়াছেন, যদ্বারা সে প্রাণীদের ন্যায় হইয়া যায়। জ্ঞানে ও আমলে প্রাণীদের ন্যায় কাজ করে। আল্লাহতায়ালার মেহেরবানীর সেফাত যখন পাথরের মধ্যে প্রকাশ পায়, তখন পাথরের শক্ত ক্রিয়াও সবুজে পরিণত হইয়া যায়। অর্থাৎ, শক্ত পাথর আল্লাহর রহমতের ফায়েজের কারণে মানুষের প্রতি মেহেরবান ও দানশীল হইয়া পড়ে। যে বস্তু উত্তমের নিকট হইতে পাওয়া যায় উহা উত্তম-ই হয়।
জান ও দেলরা তাকতে আঁ জুশে নিস্ত,
বাকে গুইয়াম দর জাহাঁ এক গোশে নিস্ত।
হর কুজা গুশে বুদ আজওয়ায়ে চশমে গাস্ত,
হরকুজা ছংগেবুদ আজওয়ায়ে এশাম গাস্ত।
কেমিয়া ছাজাস্ত চে বুদ কেমিয়া,
মোজেজাহ্ বখ্শাস্ত চে বুদ ছেমিয়া।
ইঁ ছানা গোফ্তান জে মান তরকে ছানাস্ত,
কা ইঁ দালীল হাস্তি ও হাস্তি খাতাস্ত।
পেশে হাস্ত উ ববাইয়াদ নিস্তে বুদ,
চীস্তে হাস্তী পেশে উ কোর ও কাবুদ।
গার না বুদে কো রা আজু বগোদাখ্তে,
গার মী খুরশীদ রা ব শেনাখ্তে।
দরনাবুদে উ কাবুদ আজ তাজিয়াত,
কায়ে ফাছার দে হামচুয়েখইঁ নাহিয়াত।
অর্থ: এখানে মাওলানা আল্লাহতায়ালার কুদরতের ভেদ ও তাঁহার শান বর্ণনা করিয়া বলিতেছেন, আল্লাহ্তায়ালার কুদরতের ভেদ ও রহস্য বুঝিতে যাইয়া যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়, তাহা অন্তরে ও প্রাণে সহ্য করার শক্তি নাই। আমি কিছু ভেদ বর্ণনা করিতাম, কিন্তু কাহার নিকট বয়ান করিব, সমস্ত দুনিয়ায় একটি কানও শোনার মত নাই। যদি বলি, তবে এন্কার করিয়া বসিবে, তাহাতে সে কাফের হইয়া যাইবে। তাই মওলানা কবুল করার মত কানের ফজিলত সম্বন্ধে বর্ণনা করিতেছেন, যে ব্যক্তি দৃঢ় বিশ্বাসের সহিত শোনে, তাহার শোনার কান তৈয়ার হইয়া যায়, এবং ইলমে ইয়াকীন পয়দা হয়। যে অন্তর পাথরের ন্যায় শক্ত হয়, উহাও ইলমে ইয়াকীন দ্বারা শ্রবণ করিলে অন্তর নরম হইয়া কামেল হইয়া যায়। ইল্মে ইয়াকীন এমন বস্তু, যাহা দ্বারা প্রকাশ্যে স্বচক্ষে দেখা যায়। অসম্পূর্ণ হইতে পূর্ণতা লাভ করা যায়। ইহাও আল্লাহর কুদরতের রহস্য। তাই মাওলানা কীমিয়ার কথা বলিতেছেন, কীমিয়া প্রকৃত পক্ষে কী? উহা জাতে পাকের কুদরত। ঐ কুদরতে খোদার দরুণ অসম্পূর্ণ ব্যক্তি পূর্ণতা লাভ করে। এবং কীমিয়া প্রকৃত আল্লাহ্ পাকের মোজেজা দান করা। মাওলানা বলেন, নিজের তারীফ নিজে না করাই প্রশংসা। কেননা, নিজের প্রশংসা করাই নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করে। ফানা-ফীল্লাহ্র মধ্যে নিজের অস্তিত্ব থাকিতে পারে না। নিজের অস্তিত্ব থাকা দূষণীয়। ব্যক্তির অস্তিত্ব আল্লাহ্র সম্মুখে নিস্তি হইয়া যায়। আল্লাহর সম্মুখে যদি ব্যক্তির অস্তিত্ব বাকী থাকে, তবে মনে করিতে হইবে অন্তরের দিক দিয়া সে অন্ধ। যদি সে অন্ধ না হইত, তবে দুনিয়ার বিপদ মুসিবতে গ্রেফতার হইত না, দুনিয়ার প্রতি আকৃষ্ট হইত না। মৃতের ন্যায় অন্ধ বলিয়া খোদার তাজাল্লি দেখিতে পায় না। তাজিয়া পরিধান করিয়া দুনিয়ার ফেতনায় আবদ্ধ হইয়া পড়িয়াছে।
উজির নিজের ধোকাবাজীতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঘটনা
হামচযু শাহ নাদান ও গাফেল বুদ উজির,
পানজা মী জাদ বা কাদীমে না গোজীর।
না গোজীর জুমলা গানে হাইউ কাদীর,
লা ইয়া জালু ওয়ালাম ইয়াজাল ফরদুন ও বছীর।
বা চুনাঁ কাদের খোদায়ে কাজ আদম,
ছদ চু আলম হাস্ত গরদানাদ বদম।
ছদ চু আলম দর নজর পয়দা কুনাদ,
চুঁ কে হাশমত রা বখোদ বীনা কুনাদ।
অর্থ: মাওলানা বলেন, উজির বাদশাহর ন্যায় জাহেল ও গাফেল ছিল। বে-নাইয়াজ পাক জাতের বিরোধিতা করিতেছিল। আর্থাৎ, আল্লাহতায়ালা ঐ সময় ঈসায়ী ধর্ম কবুল করিয়া উহা প্রচারের জন্য আদেশ দিয়াছিলেন। বাদশাহ্ এবং উজির ইহা ধ্বংস করিয়া দিবার চেষ্টায় ছিল। আল্লাহতায়ালা সকলের আশ্রয়স্থল, কেহই তাঁহার নিকট হইতে অ-মুখাপেক্ষী নয়। তিনি সর্বদা জীবিত, সর্বশক্তিমান, সব সময়েই আছেন এবং থাকিবেন। তিনি অদ্বিতীয়, সকলের বিষয় দর্শন করেন। তিনি এমন শক্তিশালী যে, এই পৃথিবীর মত হাজার হাজার পৃথিবী মুহূর্তের মধ্যে সৃষ্টি করিতে পারেন। তোমাকে মারেফাতের আলো দান করিতে পারেন, তখন তিনি তোমার চক্ষের সম্মুখে শত শত পৃথিবী সৃষ্টি করিয়া দেখাইতে পারেন। কমিনা উজির এমন খোদার বিরোধিতা করিতেছিল।
গার জাহান পেশাত আজীম ও পুর তনাস্ত,
পেশে কুদরাত জররায়ে মীদাঁকে নীস্ত।
ইঁ জাহান খোদ হাবছে জানেহায়ে শুমাস্ত,
হায়ে রুইয়াদ আঁছু কে ছাহরায়ে খোকাস্ত।
ইঁ জাহান মাহ্দুদ ও আঁ খোদ বেহ্দাস্ত,
নকশো ও ছরাতে পেশে আঁ মায়ানি ছদাস্ত।
ছদ হাজারানে নেজায়ে ফেরআউন রা,
দরশে কাস্ত আজ মুছা বা এব আছা।
ছদ হাজারানে তেব্বে জালিয়া নূছে বুদ,
পেশে ঈছা ও দমাশ, আফছুছে বুদ।
ছদ হাজারানে দফ্তরে আশ্য়ারে বুদ,
পেশে হরফে উম্মিয়াশ আঁ আরে বুদ।
অর্থ: এখানে মাওলানা ইহ-জগতকে খোদার কুদরতের সামনে নগণ্য বলিয়া দেখাইয়াছেন। তারপর (ইহ-জগতের) এই প্রকাশকে বাতেনী জগত হইতে আয়তনে খুব ছোট বলিয়া প্রমাণ করিয়াছেন। মাওলানা বলেন, যদিও এই বিশ্ব তোমার কাছে অতি বড় ও প্রকাণ্ড বলিয়া মনে হয়, কিন্তু জানিয়া রাখ, খোদার কুদরতের নিকট ইহা একটি অণু বরাবর বলিয়াও মনে হয় না। ইহ-জগত তোমার জন্য স্রেফ একটি কয়েদখানাস্বরূপ। তুমি খোদায়ী জগতের দিকে মনোনিবেশ করো, যাহা অতি প্রশস্ত। এই পৃথিবীর আকৃতি ও কারুকার্য্য হইতে ঐ পৃথিবীর নকশা ও কারুকার্য্য অতি উত্তম। ইহ-জগতের সাথে বন্ধুত্ব থাকিলে পরকাল হইতে ফিরিয়া থাকা হয়। ঐ পৃথিবী হইতে এই পৃথিবীর কার্যকলাপ অতি দুর্বল। তাই মাওলানা দৃষ্টান্ত দিয়া বর্ণনা করিতেছেন, ফেরাউনের যাদুকরদের শত সহস্র যাদুর লাঠি হজরত মূসা (আ:)-এর এক লাঠির সম্মুখে পরাজয় বরণ করিল। যেহেতু যাদুকরদের লাঠিসমূহে ঐ পৃথিবীর কোনো ক্রিয়া ছিল না, যাহা মূসা (আ:)-এর লাঠিতে ছিল। ইহা দ্বারাই শক্তি ও দুর্বলতার প্রমাণ হয়। লক্ষ লক্ষ জালিয়ানুছ তবীব বিদ্যমান ছিল, কিন্তু ঈসা (আ:) ও তাঁহার ফুঁকের সম্মুখে ইহা একটা খেলনার ন্যায় ছিল, ইহা তবীবদের জন্য অত্যন্ত দুঃখের বিষয় ছিল। তেব্বে ইউ নানীর মধ্যে ইহ-জগতের ক্রিয়া ছিল, আর ঈসা (আ:)-এর ফুঁকের মধ্যে ঐ পৃথিবীর ক্রিয়া ও বরকত ছিল। আমাদের হুজুর (দ:)-এর পবিত্র জামানায় জাহেলিয়ত যুগের আশ্য়ারের লক্ষ লক্ষ দফতরসমূহ স্তূপাকারে বিদ্যমান ছিল। কিস্তু আল্লাহ্র উম্মি নবীর প্রতি অবতীর্ণ আল্লাহ্র কালামের সামনে উহা মুখ হইতে নির্গত হওয়া লজ্জার কথা ছিল। কেননা ঐ সমস্ত বয়ানের মধ্যে ইহ-জগতের ফাছাহাত ও বালাগাত পরিপূর্ণ ছিল। আর আল্লাহর কালামের মধ্যে ঐ জগতের মাধুর্য্য পরিপূর্ণ ছিল।
বা চুনিঁ গালেবে খোদাওয়ান্দে কাছে,
চু নামীরাদ গার না বাশদ উ খাছে।
বাছ দেলে চুঁ কোহেরা আংগিখত উ,
মোরগে জীরাক বা দোপা আওবীখ্ত উ।
ফাহাম ও খাতের তেজ করদান নিস্তে রাহ,
জুজ শেকাস্তাহ মী নাগীরাদ ফজলে শাহ্।
অর্থ: মাওলানা বলেন, এই রকম জয়ী খোদার সম্মুখে কোনো ব্যক্তি নম্রতা সহকারে আনুগত্য স্বীকার করিবে না কেন; যদি সে কমিন না হয়। তাঁহার এমন শক্তি যে, অনেক ব্যক্তি যাহারা দৃঢ়ভাবে পাহাড়ের ন্যায় স্থায়ী ছিল, তাহাদিগকে সমূলে উৎপাটন করিয়া দিয়াছেন। যেমন, বালাম বাউর ঘটনা – তাহাকে সমূলে উৎপাটন করিয়া ধূলিসাৎ করিয়া দিয়াছেন। আর তোতা পাখী শিকার হবার সময়ে দুই পা উপরে দিয়া রশির সাথে ঝুলিয়া থাকে; শিকারীরা আসিয়া ধরিয়া নিয়া যায়। অতএব বুঝা গেল যে, বুদ্ধি ও খেয়ালতেজ করিলেই খোদাকে পাওয়ার পথ পাওয়া যায় না। নম্রভাবে বাধ্যতা স্বীকর করিলেই খোদাতায়ালা কবুল করিয়া লন।
আয় রছা গঞ্জেআগ্নানে গঞ্জে উ,
কা আঁ খেয়ালে আন্দেশেরা শোদরেশে গাউ।
গাউ কে বুদ তা তু রেশে উ শওবি,
খাকে চে বুদ তা হাশিশে উ শওবি।
জর ও নক্রাহ চীস্ত তা মফ্তুনে শওবি,
চীস্তে ছুরাতে তা চুনী মজনুন শওবী।
ইঁ ছারা ও বাগে তু জেন্দানে তুস্ত,
মুলকো ও মালে তু বালায়ে জানে তুস্ত।
অর্থ: মাওলানা এখানে দুনিয়ার মাল-মাত্তার নেশায় যাহারা মত্ত, তাহাদের নিন্দা করিয়া বলিতেছেন, অনেক লোক, যাহারা ধন সম্পদ গুদামজাত করে এবং সর্বদা গুদামজাত করার চেষ্টায় ব্যস্ত থাকে, তাহারা বোকা, ভবিষ্যতের চিন্তা করে না। দুনিয়া এমন কী বস্তু যাহার ঘাসের ন্যায় তুমি হইতেছ। অর্থাৎ, দুনিয়ার ধন-সম্পদ জমাকরণের চেষ্টায় তুমি সর্বদা ব্যস্ত থাক এবং আস্তে আস্তে ঘাসের ন্যায় তৃণ হইয়া যাইতেছ। ইহাতে তোমার লাভ কী? স্বর্ণ ও রৌপ্য এমন কোন্ বস্তু, যাহার জন্য পাগল হইয়া যাইতেছ। এই দুনিয়া এমন কী জিনিস, যাহার জন্য তুমি মজ্নুন হইয়া যাও। তোমার এই ঘর-বাড়ী, বাগ-বাগিচা, এ সবই তোমার কারা-ঘর। সাময়িকভাবে তুমি ইহার মহব্বতে আবদ্ধ আছ। তোমার রাজত্ব ও ধন-দৌলত সবই তোমার জানের শত্রু। ইহার জন্য তোমাকে নিশ্চয় শাস্তি ভোগ করিতে হইবে।
আঁ জমায়াত রা কে ইজ্ দে মছখে করদ,
আয়াতে তাছবীরে শাঁ রা নছখে করদ।
চুঁ জনে আজ কারে বদ শোদ রুয়ে জরদ,
মছখে করদ উরা খোদা ও জোহরা করদ।
আওরাতেরা জোহরা করদান মছখে বুদ,
আবো গেল গাস্তান না মছখাস্ত আয় আনুদ।
রূহে মী বুরাদাত ছুয়ে চরখে বরীঁ,
ছুয়ে আবও গেল শোদী দর আছফালীন।
পাছ তু খোদরা মছখে করদী জেইঁ ছফুল,
জা আঁ ওজুদে কে বুদ আঁ রেশকে অকুল।
পাছ বদ আঁ কেইঁ মছখে করদান চুঁ বুদ,
পেশে আঁ মছখে ইঁ বগায়েতে দুনে বুদ।
অর্থ: এখানে মাওলানা দুনিয়ার স্বাদ গ্রহণকারীর পরিণতি সম্বন্ধে বলিতেছেন, যাহাদিগকে আল্লাহতায়ালা আকৃতি পরিবর্তন করিয়া দিয়াছেন এবং পরিবর্তনের কারণ পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করা হইয়াছে; তাহাদের মধ্যে একজন মেয়েলোকও আছে, যাহার বদকাম করিয়া চেহারা হলুদ বর্ণ হইয়া গিয়াছিল, তখন আল্লাহতায়ালা তাহার আকৃতি পরিবর্তন করিয়া দিয়া জোহরা সেতারা বানাইয়া দিয়াছিলেন। যখন মেয়েলোককে জোহ্রা সেতারা বানাইয়া দেওয়ার মছখ হইতে পারে, অর্থাৎ আকৃতি বদল হইতে পারে, তখন মানুষের শারীরিক প্রকৃতির স্বভাব রূহানী স্বভাবের উপর জয়লাভ করাকে আকৃতি বদল বা মছখ বলা যাইবে না কেন? মাওলানা নাফরমান বলিয়া সম্বোধন করিয়া বলিয়াছেন, হে নাফরমান! রূহানী আকাঙ্ক্ষা এবং আশা যদি পানি ও মাটির আশা এবং আকাঙ্ক্ষায় পরিণত হয়, তবে তাহাকে মছখ বা পরিবর্তন বলা যাইবে না কেন? তোমার রূহ্ তোমাকে নিয়া আসমানে আল্লাহর নিকট পৌঁছাইতে চাহিয়াছিল। কিন্তু তুমি তোমার খাহেশে নফ্সানীর বশবর্তী হইয়া সর্বনিম্ন স্তরে যাইয়া পৌঁছিয়াছ। অর্থাৎ, আল্লাহ হইতে অনেক দূরে যাইয়া উপস্থিত হইয়াছ। অতএব, তুমি এই নিম্নস্তরে যাইবার কারণেই নিজেকে পরিবর্তন করিয়া ফেলিয়াছ। প্রকৃতপক্ষে তোমার এই পরিবর্তন জোহ্রার পরিবর্তনের চাইতে অত্যন্ত অধমের কাজ। আদম-জাতের আহকামে রূহানী ও মারেফাতে ইলাহীর জন্য ফেরেস্তারা হিংসা পোষণ করিয়াছিল, সেই নিয়ামত ত্যাগ করিয়া তোমরা আজ অধঃপতনের নিম্নস্তরে যাইয়া বসিয়া রহিয়াছ।
আছপে হিম্মাত ছুয়ে আখুর তাখতে,
আদমে মাছ্জুদেরা না শেনাখ্তে।
আখের আদম জাগাহ্ আয়ে না খল্ফে,
চান্দে পেন্দারী তু পুস্তিরা শরফে।
চান্দে গুই মান বেগীরাম আলমে,
ইঁ জাহাঁরা পুর কুনাম আজ খোদহামে।
অর্থ: মাওলানা বলেন, তুমি সাহসের ঘোড়াকে দুনিয়ার স্বাদ গ্রহণের জন্য ধাবিত করিয়াছ, দিবা-রাত্রি সর্বদা-ই তুমি দুনিয়ার স্বাদ লাভ করার জন্য ব্যস্ত আছ। হজরত আদম (আ:) যাঁহাকে ফেরেস্তারা সেজদাহ্ করিয়াছিল, তাঁহাকে চিনিতে পারিলে না! হে নাফরমান, তুমি ত সেই আদমেরই সন্তান, তুমি কেন তোমার শক্তি ও সম্মান দুনিয়া হাসিল করার জন্য নষ্ট করিতেছ? কতদিন পর্যন্ত তোমার অধঃপতনকে সম্মান ও উন্নতি বলিয়া মনে করিবে? আর কতদিন খেয়াল করিবে যে, সমস্ত দুনিয়াকে আমার আয়ত্ত্বে আনিব এবং শাসন করিব।
গার জাহান পুর বরফে গরদাদ ছার বছার,
তাবে খোর ব গোদাজাদাশ দর এক নজর।
ওয়াজরে উ ও বেজ্ রে চুঁউ ছদ হাজার,
নিস্তে গরদানাদ খোদা আজ এক শরার।
আইনে আঁ তাখাইউল রা হেকমাতে কুনাদ,
আইনে আঁ জহরে আব রা শরবত কুনাদ।
আঁগুমান আংগীজরা ছাজাদ ইয়াকীন,
মহর হা রুইয়ানাদ আজ আছবাবে কীন।
পরওয়ারাদ দর আতেশ ইবরাহীম রা,
আইমানে রূহ্ ছাজাদ বীমে রা।
দর খারাবী গন্জেহা পেন হাঁ কুনাদ,
খারেরা গুল জেছমে হারা জানে কুনাদ।
অর্থ: উপরে দুনিয়ার লোভ-লালসা ত্যাগ করার জন্য উপদেশ দেওয়া হইয়াছে। যাহারা দুনিয়ার মহব্বতে আবদ্ধ আছে, তাহারা এখন কীভাবে দুনিয়ার ভালোবাসা ত্যাগ করিতে পারে এবং ত্যাগ করিলে পিছনের পাপ কেমন করিয়া মোচন হইতে পারে, সেই সম্বন্ধে মাওলানা বলিতেছেন, তোমার পিছনের গুণাহের কথা ভাবিতেছ! উহা আল্লাহর মেহেরবানীর নিকট বরফের ন্যায় মনে কর। সমস্ত পৃথিবী যদি বরফে পরিপূর্ণ হইয়া যায়, তবু সূর্যের কিরণের সম্মুখে উহা কিছু নহে, মুহূর্তের মধ্যে উহা গলাইয়া দিতে পারে। এইরূপভাবে তোমার পাপ যতই হউক না কেন, খোদার মেহেরবানীর সম্মুখে সবই বিলীন হইয়া যাইবে। অর্থাৎ, খোদাতায়ালা মেহেরবানী করিয়া ক্ষমা করিয়া দিতে পারেন। তোমার পাপের বোঝা যতই ভারী হউক না কেন, অর্থাৎ হাজার বোঝার ন্যায় ভারী হইলেও আল্লাহ্তায়ালা ইশকের সামান্য স্ফুলিঙ্গ দ্বারা সব ধ্বংস করিয়া দিতে পারেন। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর ইশকে এই রকমই ক্রিয়া আছে। যে জীবন ভরিয়া আল্লাহ ছাড়া অন্যে লিপ্ত ছিল কিন্তু আল্লাহর অনুগ্রহে তাঁহার ইশকের প্রভাবে মুহূর্তের মধ্যে সব দূর হইয়া যায় এবং তোমার খারাপ ধারণার যে আশঙ্কা থাকে, উহার মধ্যে আল্লাহর কারুকার্য নিহিত আছে। ঐ সমস্ত খারাপ ধারণাকে প্রকৃতপক্ষে খাঁটি হেক্মত রূপে রূপান্তরিত করিয়া খারাপ ধারণাসমূহকে উপকারী জ্ঞানে পরিণত করে। যেমন, ঐ ব্যক্তি খারাপ কাজের সম্বন্ধে এত অভিজ্ঞতা লাভ করে যে, কেহ কোনো সময় আর খারাপ কাজের ধোকায় ফেলিতে পারে না। যেমন বলা হয় খারাপকে চিনিয়াছি, খারাপ কাজ করার জন্য নয়; বরং উহা হইতে রক্ষা পাইবার জন্য। যে ব্যক্তি ভাল-মন্দ পার্থক্য করিতে জানে না, সে মন্দের মধ্যে পতিত হয়।
আজ ছবাবে ছুজিয়াশে মান ছুদায়েম,
ওয়াজ্ খেয়ালাতাশ চু ছুফছ্ তাইয়েম।
দর্ ছবাবে ছাজিয়াশে ছার গর্দান্ শোদেম,
ওয়াজ্ ছবাবে ছুজিয়াশ্ হাম্ হয়রান্ শোদাম্।
অর্থ: মাওলানা বলেন, আল্লাহতায়ালার জ্বলনের কারণে আমি উপকৃত হইয়াছি এবং চিন্তিত আছি। এই জ্বলনের কারণ সম্বন্ধে চিন্তা করিতে যাইয়া আমি ছুফাছতাইয়া সম্প্রদায়ের ন্যায় হইয়া পড়িয়াছি। অর্থাৎ-ছুফাছ্তাইয়া দল যেমন এই পৃথিবীতে কোনো বস্তুর ক্রিয়া স্বীকার করে না, সেইরূপ আমি আল্লাহর জ্বলনের কোনো কারণ তালাশ করিয়া পাইতেছি না। শুধু আল্লাহর ইশকে জ্বলনই জ্বলনের কারণ দেখা যায়।
ধোকাবাজ উজির কওমে ঈছা (আঃ) এর লোকদিগকে পথভ্রষ্ট করার উত্তেজনা বৃদ্ধি করার ঘটনা
চুঁ উজিরে মাকেরে বদ্ ইতেকাদ্
দীনে ঈছারা বদল করদ আজ ফাছাদ।
মক্রে দীগার্ আঁ উজির আজ খোদ ব বাস্ত,
ওয়াজরা ব গোজাস্ত দর্ খেলাওয়াত নেশাস্ত।
দর্ মুরিদানে দর্ ফাগান্দ আজ শওকে ছুজ,
বুদ দর্ খেলাওয়াত চেহেল পান্জাহ রোজ।
খলকে দউয়ানা শোদান্দ আজ শওকে উ,
আজ ফেরাকে হাল ও কাল ও জওকে উ।
লাবায়ে ও জারী হামী কর্দান্দ উ,
আজরিয়া জাত গাস্তাহ্ দর খেলাওয়াতে দাও তু।
গোফতাহ ইশাঁ বে তু মারা নিস্তে নূর,
বে আছা কাশ চুঁ বুদ আহ্ওয়ালে কুর্।
আজছারে ইকরাম ও আজ বহরে খোদা,
বেশে আজ ইঁ মারা মদার আজখোদে জুদা।
মা চুঁ তেফ্ লানেম্ ও মারা দাইয়ায়ে তু,
বর্ ছারে মা গাস্তারানে আঁ ছায়াতু।
অর্থ: যখন ঐ ধোকাবাজ খারাপ মনোভাবাপন্ন উজির ঈসায়ী ধর্মকে পরিবর্তন করিয়া খারাপ করিয়া ফেলিল, তখন সে আর একটা নুতন ফন্দি আঁটিল এবং ওয়াজ-নসীহত করা ত্যাগ করিয়া একাকী এক স্থানে নির্জনতা অবলম্বন করিল; কাহাকেও দেখা সাক্ষাৎ করিতে দিত না এবং কাহারও সাথে কথা বলিত না। সমস্ত মুরিদানের মধ্যে তাহার জুদায়ীতে বেদনা ছড়াইয়া পড়িল। প্রায় চল্লিশ দিন অথবা পঞ্চাশ দিন পর্যন্ত একাকী নির্জনে কাটাইল। সমস্ত লোক তাহার আকাঙ্ক্ষায় তাহার কথাবার্তা ও সাক্ষাৎ হইতে দূরে থাকায় পাগল হইয়া গেল এবং সকলে কান্নাকাটি শুরু করিল। এদিকে উজির নির্জনতা অবলম্বন করিয়া চলিল। মুরিদেরা বলিতে লাগিল, “আমরা আপনার ফায়েযের আলো ছাড়া হেদায়েত পাইতে পারি না, আমাদের লাঠি যদি না থাকে, তবে আমরা অন্ধ – আমাদের অবস্থা কী হইবে? আপনার বোজর্গির দোহাই, আল্লাহর ওয়াস্তে আমাদিগকে এর বেশী পৃথক রাখিবেন না। আমাদের অবস্থা তো শিশু বাচ্চার ন্যায়, আর আপনি আমাদের পক্ষে ধাইমা’র মত। আপনি আপনার অনুগ্রহের ছায়া আমাদের মাথার উপর বিছাইয়া রাখিবেন।”
বিশেষ দ্রষ্টব্য: এখানে বুঝা যায় যে মুরিদ যত দিন পর্যন্ত কামেল না হয়, ততদিন পর্যন্ত পীরে কামেল হইতে দূরে যাইতে হয় না। পীরের নিকট থাকিয়া খেদমত করাই উত্তম।
গোফ্তে জানাম আজ মুহেব্বানে দূর নীস্ত,
লেকে বেরুঁ আমদান্ দস্তুরে নীস্ত।
অর্থ: উজির উত্তরে বলিয়া দিল, যদিও আমার দেহ তোমাদের নিকট হইতে দূরে রহিয়াছে, কিন্তু আমার প্রাণ বন্ধুদের হইতে দূরে নয়। অর্থাৎ, আমার প্রাণ তোমাদের সাথেই আছে, কিন্তু তোমাদের নিকট বাহির হইবার হুকুম নাই।
আঁ আমিরানে দর্ শাফায়াত আমদান্দ,
ওয়া আঁ মুরিদাঁ দর্ জারায়াত আমদান্দ।
কা ইঁ চে বদ্ বখ্তীস্ত মারা আয় করিম,
আজ দেল ও দীন মান্দাহ্ মাবী তু ইয়াতীম।
তু বাহানা মী কুনী ও মা জে দরদ্
মী জানেম আজ ছুজে দেল্ দমহায়ে ছরদ।
মা বে গোফতারে খোশত্ খো করদায়েম,
মা জে শীরে হেকমতে তু খোর্দায়েম।
আল্লাহ আল্লাহ ইঁ যাফা বা মাকুন,
লুৎফে কুন্ এমরোজেরা ফরদা মকুন।
মী দেহাদ দেলে মর তোরা কেইঁ বে দেলাঁ,
বে-তু গরদানাদ আখের আজ বে হাছেলাঁ।
জুমলা দর্ খুশকী চু মাহী মী তপান্দ,
আবে রা ব কোশা জে জওবর্ দার্বন্দ।
ইকে চুঁ তু দর্জমানায় নীস্তে কাছ,
আল্লাহ আল্লাহ খলকেরা ফরইয়াদে রছ।
অর্থ: ঐ বারো নেতা উজিরের কাছে সুপারিশ করিতে লাগিল এবং জনগণ অর্থাৎ সাধারণ মুরিদগণ জারেজার হইয়া কাঁদিতে আরম্ভ করিল এবং বলিতে লাগিল, ইহা আমাদের জন্য অত্যন্ত বদ-নসীবের কথা; আপনার সোহবত ব্যতীত আমাদের মন শান্তি পাইতে পারেনা এবং আমাদের ধর্মে হেদায়েত হইতে পারে না। আপনার হেদায়েত ব্যতীত আমাদের ধর্ম একদম ধ্বংস হইয়া যাইবে। আপনি বাহানা করিতেছেন, আর আমাদের অন্তঃকরণ জ্বলিয়া ছাই হইয়া যাইতেছে। ঠান্ডা নিঃশ্বাস ছাড়িতেছি। কেননা, আমাদের আপনার উপদেশ শোনার অভ্যাস হইয়া গিয়াছে। আপনার জ্ঞানের মিঠা শরবত পান করিয়াছি। আল্লাহর ওয়াস্তে আমাদের সাথে কঠিন ব্যবহার করিবেন না। আমাদের অবস্থার উপর দয়া করিয়া মেহেরবানী করিবেন। অদ্য-ই দয়া করিবেন, কালকের জন্য নয়। আপনি কি পছন্দ করেন যে এই সমস্ত অজ্ঞ লোক আপনাকে ব্যতীত অসম্পূর্ণ থাকিবে? ইশকের উত্তেজনায় এইরূপ বেয়াদবী অন্যায় নয়। মুরিদেরা সকলেই এইরূপ ব্যস্ত ছিল, যেমন – মাছ স্থলে উঠিলে অসুবিধায় পড়ে। এখন আপনার ফায়েজের নহর জারী করিয়া দেন। আপনার সমকক্ষ এই দুনিয়ায় আর কেহ নাই। আল্লাহর ওয়াস্তে আমাদের জন্য খোদার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করুন।
মসনবী শরীফ – (৪০)
মূল: মাওলানা রুমী (রহ:)
অনুবাদক: এ, বি, এম, আবদুল মান্নান
মুমতাজুল মোহাদ্দেসীন, কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা
মুরীদগণের পুনরায় উজিরকে নির্জনতা ভঙ্গ করার প্রার্থনা করা
জুম্লা গোফ্তান্দ আয়ে হাকীমে রোখ্না জু,
ইঁ ফেরেব্ ও ইঁ জাফা বা মা মগো।
মা আছিরানেম তাকে ইঁ ফেরেব্,
বে দেল্ ও জানেম তাকে ইঁ এতাব।
চুঁ পিজী রফ্ তী তু মারা আজ এব্তেদা,
মার হামাত্ কুন্ হাম চুনিঁ তা ইন্তেহা।
জোয়ফ্ ও এজ্জো ও ফকরে মা দানেছতা,
দরদে মারা হাম্ দাওয়া দানেছতা।
অর্থ: সকল মুরীদ উজিরের প্রতিউত্তরে আরজ করিল, হে হেকীম, এইরূপ ধোকাবাজী এবং অত্যাচার আমাদের প্রতি করিও না। এরূপ রূঢ় ব্যবহার ও কর্কশ বাক্য আমাদের প্রতি প্রয়োগ করিও না। আমাদের হইতে মুখ ফিরাইয়া নিও না। যাহাতে আমাদের অন্তর জ্বলিয়া পুড়িয়া ছাই হইয়া যায়। যখন আমাদিগকে প্রথম হইতে স্বীকার করিয়া লইয়াছ, তবে শেষ পর্যন্ত একইভাবে দয়া প্রদর্শন করিতে থাক। আমাদের অন্তরের দুর্বলতা, অপারগতা ও তোমার প্রতি আমাদের মুখাপেক্ষী হওয়া সম্বন্ধে তুমি সম্যক অবগত আছ। আমাদের অন্তরের ব্যথার প্রতিকার তোমার নৈকট্য লাভ, ইহাও তুমি জানো। অতএব, নির্জনতা ভঙ্গ করিয়া আমাদের দেখাশুনা কর।
চারে পারা কদরে তাকত্ বারে নেহ্,
বর্ জয়ীফানে কদ্রে কুওয়াত কারে নেহ।
দানায়ে হর্ মোরগে আন্দাজাহ্ ওয়ায়আস্ত,
তায়ামায়ে হর্ মোরগে আন্জীরে কায়ে আস্ত।
তেফ্লেরা গার্নানেদিহী বর জায়ে শির,
তেফলে মীছকীন রা আজাঁ নানে মোর্দাহগীর।
চুঁ কে দান্দানেহা বর্ আরাদ বাদে আজ আঁ,
হাম্ব খোদ গরদাদ দেলাশ জুইয়ায়ে নাঁ।
মোরগে পর্ না রেস্তাহ্ চুঁ পররাঁ শওয়াদ,
লোক্মায়ে হর্ গোর্বায়ে দররাঁ শওয়াদ।
চুঁ বর্ আরাদ পর্ বপর্রাদ উ বখোদ,
বে তাকাল্লুফ বে ছফীরে নেক্ ও বদ।
অর্থ: মাওলানা এখানে শায়েখে কামেলের জন্য শিক্ষা পদ্ধতি বাতলাইয়া দিতে যাইয়া বলিতেছেন, শিক্ষার্থীকে তাহার শক্তির বাহিরে কোনো শিক্ষা দেওয়া বা কোনো কাজ চাপাইয়া দেওয়া উচিত হইবে না। যেমন প্রথম দৃষ্টান্ত দিয়া বলিয়াছেন, চতুষ্পদ জানোয়ারের উপর তাহার শক্তি অনুযায়ী বোঝা চাপান চাই। এইরূপভাবে দুর্বলের উপর তাহার ক্ষমতা অনুযায়ী কাজ দেওয়া চাই। দ্বিতীয় উদাহরণে দেখাইয়াছেন, প্রত্যেক পাখীর খোরাকের দানা ইহার আন্দাজ অনুযায়ী আছে। প্রত্যেক পাখীর খোরাক আঞ্জির ফল হইতে পারে না। তৃতীয় দৃষ্টান্তে বলিয়াছেন, যদি দুধের শিশুকে দুধের পরিবর্তে রুটি খাইতে দিতে থাক, তবে ঐ বেচারা শিশুকে রুটির কারণে মৃত মনে করিতে পার। হাঁ, যখন তাহার দাঁত গজাইয়া উঠিবে, তখন সে নিজেই রুটি চাহিয়া লইবে। চতুর্থ দৃষ্টান্ত, যে পাখীর পাখা গজাইয়া উঠে নাই, ইহা যদি উড়িতে আরম্ভ করে, তবে নিশ্চয় করিয়া জানিয়া রাখ, সে বিড়ালের খাদ্যে পরিণত হইবে। যখন ইহার পাো বাহির হইয়া আসিবে, তখন সে নিজেই বিনা কষ্টে, কাহারও সাহায্য ব্যতিরেকে উড়িতে আরম্ভ করিবে। এইরূপভাবে যদি শিক্ষার্থীর প্রথম অবস্থায় কামেল মনে করিয়া ব্যবহার করা হয়, অথবা সে নিজে যদি নিজেকে দক্ষ মনে করে, তবে নিশ্বয়ই সে পথভ্রষ্ট হইয়া ধ্বংস হইয়া যাইবে। কেননা, প্রথম অবস্থায় তাহাকে কামেলের সোহবত লাভ করিতে হইবে। ইহাকে শিশুর দুধের সহিত তুলনা করা হইয়াছে।
দেউরা নতকে তু খামুশ মীকুনাদ,
গোশে মারা গোফ্তে তু হাশ্ মীকুনাদ।
গোশে মা হুশাস্ত চুঁ গোয়া তুই,
খুশকে মা বহরাস্ত চুঁ দরিয়া তুই।
বা তু মারা খাকে বেহতার্ আজ ফালাক,
আয়ে ছামাকে আজ তু মুনাওয়ার তা ছামাক্।
বে তু মারা বর ফাল্কে তারেকীস্ত,
বা তু আয় মাহ ইঁ ফালাক তারেকীস্ত।
বা তু বর খাকে আজ ফালাক বুরদেম দস্ত
বর ছামা মা বেতু চুঁ খাকেম পোস্ত।
ছুরাতে রফায়াতে বুদ আফলাকে রা,
মায়ানি রফায়াতে রওয়ানে পাকেরা।
ছুরাতে রফায়াত বরায়ে জেছমেহাস্ত,
জেছমেহা দর পেশে মায়ানি ইছমে হাস্ত।
আল্লাহআল্লাহ এক নজর বর মা ফেগান্
লা তাক্না তেন্না ফাকাদ তালাল হুজনা।
অর্থ: উজিরের মুরীদরা বলিতেছে, আমাদের মন আপনার কথা শুনিলে শান্ত থাকে। অর্থাৎ আপনার নসীহতের মর্ম ও রহস্য শুনিয়া আমাদের অন্তঃকরণের খারাপ ধারণাসমূহ বিদূরিত হইয়া যায় এবং আত্মাসমূহ শান্তরূপ ধারণ করে। কোনো প্রকার খারাবির দিকে ধাবিত হয় না। আমাদের অন্তরের কান সজাগ থাকে, যেমন আপনি আমাদিগকে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চুপচাপ শান্ত থাকিতে বলিয়াছেন, এবং অন্তর সজাগ রাখিতে বলিয়াছেন। আমাদের প্রার্থনা ইহার বিরুদ্ধে নয়। কেননা, আত্মার দিক দিয়া চুপচাপ থাকার অর্থ ইহাই এবং ইহা আপনার কথাবার্তা ও নসীহতসমূহ শ্রবণেই হাসেল হইয়া থাকে। ইহাই আমরা চাই। অতএব, আমাদের প্রার্থনা প্রকৃতপক্ষে আপনার আদেশ পালনেরই নামান্তর। আর আপনি যে বলিয়াছেন, “তোমাদের অন্তরের কান সজাগ রাখ,” আমরাও ইহা চাই। এইজন্যই আপনার কথাবার্তা শুনার মুখাপেক্ষী। কেননা, আমাদের অন্তঃকরণ আপনার কথা ও উপদেশাবলী শুনিলেই হুঁশিয়ার থাকে। আর আমাদের শারীরিক চাহিদা রূহানি চাহিদায় পরিণত করিতে হইলে আপনার ন্যায় দরিয়ার ফায়েজের আবশ্যক। আমাদের আভ্যন্তরীণ ভ্রমণও আপনার সোহবতের দরুন হইয়া থাকে। কেননা, আপনি আমাদের সাথে থাকিলে, এই মাটির জমিন ও আসমান হইতে শতগুণে উত্তম বলিয়া মনে হয় এবং আপনি এমন ব্যক্তি, যদ্বারা এক প্রান্ত হইতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত আলোকিত হইয়া যায়। আর আপনি ব্যতীত যদি আমরা আসমানেও চলিয়া যাই, তবে আমদের নিকট আসমানও অন্ধকার বলিয়া মনে হয়। আপনি চাঁদের ন্যায়, আপনার সাথে আমরা আসমানে গেলেও আসমান অন্ধকার হইতে পারে না। অতএব, এই পৃথিবীতে আপনার সাথে থাকিয়া আপনার ওয়াজ নসীহত শুনিয়া আমাদের রূহানী আলো হাসেল হইবে। আর আপনি যদি আমাদের নিকট হইতে দূরে থাকেন এবং আমরা যদি আসমানেও পৌঁছে যাই, তথাপি আমরা রূহানী আলো হইতে বঞ্চিত থাকিব। কেননা, শুধু শারীরিক উচ্চস্থানে পৌঁছিলেই আত্মার উচ্চস্থানে পৌঁছা হয় না। এইজন্যই আমরা বলি, আপনার সাথে এই মাটির জমিনে থাকিয়া আসমান হইতেও অতিক্রম করিয়া যাইব এবং আপনাকে ছাড়া আসমানে থাকিয়াও অধঃস্থ জমিনের চাইতেও অধঃপতনে যাইতে হইবে। কেননা, এই আসমান শুধু প্রকাশ্যে উচুঁতে দেখা যায়। রূহের জন্য আত্মার দিক দিয়া উচ্চস্থান চাই এবং উহা আপনার সাথে থাকিলেই লাভ করা সম্ভব হইতে পারে। অতএব, আল্লাহর ওয়াস্তে আমাদের প্রতি দয়ার দৃষ্টি করুন, আমাদিগকে নিরাশ করিবেন না। কেননা,আমরা বহুত চিন্তিত হইয়া পড়িয়াছি; দুঃখে আমাদের অন্তর পরিপূর্ণ হইয়া গিয়াছে।
উত্তরে উজির বলিল, নির্জনতা ভঙ্গ করিব না
গোফতে হুজ্জাত হায়ে খোদ কোতাহ কুনেদ,
পন্দেরা দরজানো ও দর্দেলে বাহ কুনেদ।
গার্ আমিনাম্ মোত্তাহাম্ নাবুদ আমীন,
গার ব গুইয়েম্ আছমানরা মান্জমীন।
গার্ কামালাম্ বা কামাল ইনকারে চীস্ত,
দরীনাম্ ইঁ জহ্মত ও আজারে চীস্ত।
মান্ না খাহাম্ শোদ্ আজইঁ খেলওয়াত বেরুঁ,
জা আঁকে মাশ্ গুলাম বা আহ্ওয়ালে দরুঁ।
অর্থ: উজির মুরীদগণকে উত্তর দিল, তোমরা যুক্তি-তর্ক ত্যাগ কর, তোমাদিগকে যে উপদেশ দেওয়া হয়, সেই অনুযায়ী আমল কর। আমার উপর হঠকারিতা করিও না। আমাকে যদি তোমরা হিতাকাঙ্ক্ষী ও আমানতদার মনে করিয়া থাক, তবে আমানতদারের উপর মিথ্যা দোষারোপ করা উচিত না। যদিও নাকি তোমরা আসমানকে জমিন বলিয়া প্রকাশ কর। অতএব, আমি যদি তোমাদের নিকট কামেল বলিয়া পরিগণিত হই, তবে কামেলের সহিত এন্কার ও প্রশ্ন-উত্তর কেন কর? আর যদি আমি কামেল না হই, তবে গায়েরে কামেলের সাথে সম্বন্ধ স্থাপন করিয়া এত দুঃখ-কষ্ট কেন ভোগ করিতেছ? আমি কখনও এই নির্জনতা ভঙ্গ করিব না। কেননা, আমি বাতেনী কাজে লিপ্ত আছি।
লজ্জাতে ইনয়ামে খোদরা ওয়া বগীর,
নক্লো ও বাদাহাউ জামে খোদরা ওয়া মগীর।
ওয়ার বগীরি কীস্তে জুস্ত ও জু কুনাদ,
নক্শ বা আন্কাশে চুঁ নীরু কুনাদ।
ম নেগার আন্দর মা মকুন দরমা নজর,
আন্দর ইকরামে ও ছাখায়ে খোদ নেগার।
মা নাবুদেম ও তাকাজা মানে নাবুদ,
লুৎফে তুনা গোফতাহ মা মী শনুদ।
অর্থ: মাওলানা এখানে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করিতেছেন, হে খোদা, তুমি ইচ্ছাপূর্বক আমাদিগকে নেয়ামত দান করিয়াছ; উহা হইতে বঞ্চিত করিও না। অর্থাৎ, আমাদিগকে যে ইশ্ক নেয়ামতস্বরূপ দান করিয়াছ, উহা তুলিয়া নিও না। আমাদিগকে সর্বদা তোমার মহব্বতের আশেক করিয়া রাখিও। আর ইশকের যে সমস্ত হাতিয়ার আমাদের মধ্যে আছে, উহা রহিত করিয়া দিও না। অর্থাৎ তোমার ইশক লাভ করার জন্য যে বিদ্যা, মারেফত এবং বাতেনী শক্তি দান করিয়াছ, উহা হইতে আমাদিগকে বঞ্চিত করিও না। বিদ্যা ও বাতেনী শক্তি প্রখর করিয়া দিও। যদি তুমি ঐসব শক্তি ফিরাইয়া নিয়া যাইতে চাও, তবে এমন কে আছে, যে তোমার কাছে তলব করিতে পারে? কেননা, আমরা মাত্র ছবির ন্যায়; ছবি অঙ্কনকারী তুমি। ছবি কোনো সময়ে অঙ্কনকারীর বিরোধিতা করিতে পারে না। আমরা ঐ নেয়ামতের দাবীদারও হইতে পারি না। কারণ, আমাদের অনেক ভুলত্রুটি ও পাপ আছে, যাহা দ্বারা আমরা ঐ নেয়ামতের উপযুক্ত হইতে পারি না। শুধু তোমার অনুগ্রহের উপর ভরসা করিয়া আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করিতে পারি। হে খোদা, তুমি যদি আমাদের প্রতি দৃষ্টি না রাখ, তবে আমাদের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ হইয়া পড়িরে। তাই তোমার বদান্যতার দরুন আমাদের প্রতি দানের দৃষ্টি রাখিও, যদিও আমরা উহার প্রকৃত দাবীদার হইতে পারি না। যেমন আমরা প্রথমে ছিলাম না, তুমি করিয়া বিদ্যমান করিয়াছ।
নকশে বাশদ পেশে নাক্কাশ ও কলম,
আজেজ ও বস্তাহ চু কোদাক দর শেকাম।
পেশে কুদরাতে খলকে জুমলাহ বারে গাহ,
আজেজ আঁ চুঁ পেশে ছুছন কারে গাহ।
গাহে নকশে দেউ এ গাহে আদম কুনাদ,
গাহে নকশে শাদী ও গাহে গম কুনাদ।
দস্তে নায়ে তা দাস্তে জম্বানাদ বদে,
নোতকে নায়ে তা দমে জানাদ আজ জরও নফা।
অর্থ: মাওলানা বলেন, ছবি অঙ্কনকারী ও তাহার কলমের সম্মুখে ছবি যেমন দুর্বল অর্থাৎ ছবির নিজস্ব কোনো মতামত প্রকাশের ক্ষমতা থাকে না এবং মাতৃগর্ভে বাচ্চার যেমন নিজের গঠন ও আকৃতির সম্বন্ধে কোনো ক্ষমতা প্রকাশ করার শক্তি থাকে না, সেই রকম মানুষেরও আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে শক্তি চালনার কোনো ক্ষমতা নাই। যেমন, সুঁচ ছেঁড়া কাপড়কে ভেলভেটরূপে তৈয়ার করিয়া দেয়। সেই রকম আল্লাহতায়ালা কখনও শয়তানের সুরত তৈয়ার করেন, আবার কখনও আদমের সুরত তৈয়ার করেন; আর কখনো কখনো সুন্দর দৃশ্য সৃষ্টি করেন। কখনও দুঃখের ছবি অঙ্কন করেন, ইহাতে মানুষের কোনো হাত নাই, বলার কোনো ভাষাও নাই। খোদার যাহা ইচ্ছা তাহা-ই করিতে পারেন। মানুষ তাঁহার বিরোধিতা করিতে সাহস পায় না এবং বিরোধিতা করার শক্তিও রাখে না।
তুজে কুর-আন্ বাজ জু তাফছিরে বয়াত,
গোফতে ইজদে মারা মাইতা ইজ রামাইতা।
গার বেররানেম্ তীরে আঁকে জেমাস্ত,
মা কামান ও তীর আন্দাজাশ খোদাস্ত।
অর্থ: মাওলানা বলেন, আমার উপরোল্লিখিত বয়াত-সমূহের ব্যাখ্যার সাহায্য পবিত্র কুরআন দ্বারা পাওয়া যায়। যেমন, আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করিয়াছেন, যখন আমাদের নবী করিম (দ:) কাফেরদের প্রতি পাথর-কুচি নিক্ষেপ করিয়াছিলেন, তখন আল্লাহ্তায়ালা ইর্শাদ করিলেন: হে নবী, যখন আপনি পাথরের কঙ্করগুলি কাফেরদের প্রতি নিক্ষেপ করিলেন, তখন উহা আপনি নিক্ষেপ করেন নাই, নিক্ষেপের মালিক স্বয়ং আল্লাহ্তায়ালা-ই। আপনি শুধু নিক্ষেপকারী, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নিক্ষেপের কর্তা আল্লাহতায়ালা। ইহা দ্বারা বুঝা যায় যে, আমরা যদি তীর চালনা করি, তবে উহা আমাদের তরফ হইতে নয়। আমরা শুধু তীরের কামানের ন্যায়, তীর নিক্ষেপকারী আল্লাহ্তায়ালা। আমরা হাতিয়ারস্বরূপ এবং কাজ প্রকাশ হবার স্থান-মাত্র। প্রকৃতপক্ষে কাজ করার মালিক আল্লাহতায়ালা। ইহাই উপরোক্ত বয়াতসমূহের ভাবার্থ।
ইঁ না যবর ইঁ মায়ানী জাব্বারী আস্ত,
জেকরে জাব্বারী বরায়ে জারীস্ত।
জারী এ মা শোদ দলিলে এজতে রার,
খাজলাতে মা শোদ দলিলে ইখতিয়ার।
গার নাবুদী ইখতেয়ারে ইঁ শরম চীস্ত,
ওয়াইঁ দেরেগ ও খাজলাত ও আজারাম চীস্ত।
যজরে উস্তাদাঁ বশাগেরদাঁ চেরাস্ত,
খাতেরে আজ তদবীর হা গরদান চেরাস্ত।
অর্থ: মাওলানা বলেন, আমি যাহা উপরে বর্ণনা করিলাম, ইহা একেবারে যবর অর্থাৎ বাধ্যতামূলক নহে। আমার বর্ণনার উদ্দেশ্য হইল যে, আমাদের শক্তির উপর আল্লাহ্র শক্তি প্রভাব বিস্তার করিতে পারে। তিনি আমাদের শক্তির উপর শক্তিশালী। এই কথা মনে করিয়া তাঁহার শক্তির নিকট আমরা সর্বদা বশ্যতা স্বীকার করিয়া থাকিব। আমাদের শক্তির বিরুদ্ধে আল্লাহর শক্তি জয়ী, এইজন্য আমাদের সব সময়ে তাহার নিকট নত থাকিতে হয়। আর আমাদের ইচ্ছাধীন শক্তি দ্বারা অনেক সময়ে কাজ করিয়া লজ্জিত হই বলিয়া আমাদের ইচ্ছাধীন শক্তি আছে, স্বীকার করিতে হয়। নতুবা লজ্জিত হই কেন? যদি আমাদের ইচ্ছাধীন শক্তি না থাকিত, তবে উস্তাদ সাহেব কেন ছাত্রদিগকে শিক্ষা করার জন্য তাকীদ করিবেন এবং শাস্তির ব্যবস্থা করিবেন? প্রত্যেক কাজ সম্পন্ন করার জন্য কেনই বা এত চেষ্টা তদবীর করা হয়? ইহা দ্বারা বুঝা যায় যে, বান্দার কিছু শক্তি তাহার ইচ্ছাধীন করিয়া দেওয়া হইয়াছে।
ওয়ার তু গুই গাফেলাস্ত আজ যবরে উ,
মাহে হক পেন্হাঁ শোদ আন্দর আবরে উ।
হাস্তে ইঁরা খোশে জওয়াব আর বেশনূবি,
বোগ জারী আজ কুফরো ও বরদীনে বগরোবী।
হাছরাত ও জারী কে দর বিমারীস্ত,
ওয়াক্তে বীমারী হামা বেদারীস্ত।
আঁ জামানে কে মী শওবী বীমারে তু,
মী কুনী আজ জুরমে ইস্তেগফারেতু।
মী নূমাইয়াদ বর্ জেস্তী গুণাহ,
মী কুনী নিয়াতে কে বাজ আইয়াম বরাহ।
আহাদ ও পায়মান মী কুনী কে বাদে আজইঁ,
জুযকে তায়াত না বুদাম কারে গুজীঁ।
পাছ ইয়াকীনে গাস্ত আঁকে বীমারি তোরা,
মী বা বখশাদ হুশো ও বেদারী তোরা।
অর্থ: মাওলানা বলেন, যদি কেহ সন্দেহ পোষণ করে যে বান্দা নিজের শক্তি দিয়া খারাপ কাজ করিয়া লজ্জিত হয় না, বরং বাধ্যগত শক্তির দরুন অন্যায় করিয়া ফেলিয়াছে, অজ্ঞতা বশতঃ ইহা জানে না বলিয়া লজ্জিত হয়, যেমন চন্দ্র, ইহার কিরণ থাকা সত্ত্বেও অনেক সময়ে মেঘের কারণে ঢাকিয়া থাকে, সেইরূপ বাধ্যতামূলক শক্তি সর্বদা প্রভাব বিস্তার করে, কিন্তু অজ্ঞতার মেঘে ঢাকিয়া রাখে, বাধ্যতামূলক শক্তি অনুভব করিতে পারে না, নিজের শক্তি মনে করিয়া লজ্জিত হয়। ইহার জওয়াবে মওলানা বলিতেছেন, রোগী যখন রোগগ্রস্ত হইয়া নিজের পাপ কার্যের জন্য অনুতপ্ত হইয়া কান্নাকাটি করে, তখন সে সম্পূর্ণ সজাগ ও ওয়াকেফহাল হইয়া পাপ হইতে তওবা ও ইস্তেগ্ফার করিতে থাকে এবং দৃঢ় সংকল্প প্রকাশ করিতে থাকে যে, আর কখনও পাপ ও অন্যায় কাজ করিব না; সর্বদা সৎপথে থাকিব। ইহা দ্বারা নিশ্চয় করিয়া বুঝা গেল যে, রোগই তাহাকে সজাগ ও হুঁশিয়ার করিয়া দিয়াছে। খারাপকে খারাপ বলিয়াই মনে করে। যদি অজ্ঞতার কারণে লজ্জিত হওয়া প্রমাণ হইত, তবে রোগের অবস্থায়ই ঐ অজ্ঞতা দূর হইত, তথাপি সে কেন গুণাহের জন্য লজ্জিত হইতেছিল, এবং তওবা করিতেছিল। অতএব, অজ্ঞতা দূর হওয়া সত্বেও লজ্জিত হওয়া ও তওবা করা প্রমাণ করে যে, প্রকৃতপক্ষে মানুষের জন্য ইচ্ছাধীন শক্তি আছে, যাহা দ্বারা সে অন্যায় ও পাপ করিতে পারে।
পাছ বেদাঁ ইঁ আছলেরা আয় আছলে জু,
হরকেরা দরদাস্ত উ বোরদাস্তেবু।
হরকে উ বেদার তর পুর দরদে তর,
হরকেউ আগাহ তর রুখে জরদেতর।
অর্থ: এখানে মাওলানা আত্মার শান্তি ও সৌন্দর্যের কথা বর্ণনা করিতে যাইয়া বলিতেছেন, যাহার জন্য মহব্বতের ব্যথা থাকিবে, তাহার মিলন সে নিশ্চয়ই পাইবে। অতএব, তোমরা এই স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম জানিয়া রাখ যে, যাহার জন্য যার ব্যথা আছে, সে নিশ্চয়ই তাহার সাক্ষাৎ পাইবে। যে ব্যক্তি ভালোবাসায় অধিক সজাগ থাকিবে, সে পূর্ণ মহব্বত লাভ করিতে পারিবে। যেমন, হাদীসে বর্ণনা করা হইয়াছে- “আল মারউ মা’আ মান আহব্বা” অর্থাৎ, মানুষ যাহাকে ভালবাসিবে, তাহার সহিত থাকিবে।
[সম্পাদনা: কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন]
Posted 25th April 2014 by Qutub Uddin Ahmed
0 Add a comment
Loading
সূফিবাদরে কথা প্রচার করা একমাত্র পাক পান্জাতনের জন্য/ পাক পান্জাতন বলতে পবিত্র পাঁচজন উনাদের নাম মোবারক (১)মোহাম্মাদ মোস্তফা (সা) (২) হযরত আলী (আঃ) (৩) খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতেমাতুজ্জুহরা (আঃ) (৪) হযরত ইমাম হাসান (আঃ) (৫) হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
মসনবী শরীফ
Kanchkura Darbar Sharif Khalifa-E- Gawsulazam Maizvandari Hazrat Mawlana Shah Sufi Abdul Motalib (M.J.A) search APR 25 মসনবী শরীফ মূল: মাও...
সুফিবাদ আত্বপরিচয়ের একমাত্র পথ
-
Kanchkura Darbar Sharif Khalifa-E- Gawsulazam Maizvandari Hazrat Mawlana Shah Sufi Abdul Motalib (M.J.A) search APR 25 মসনবী শরীফ মূল: মাও...
No comments:
Post a Comment